রবিবার, ৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

ইসলামে মানুষ হত্যার শাস্তি

ইসলামে নিরপরাধ মানুষ হত্যা জঘন্যতম অপরাধ। পবিত্র কোরআনের ভাষায়- পুরো মানবজাতিকে হত্যা করার মতো। ইরশাদ হয়েছে, ‘নরহত্যা বা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের কারণ ছাড়া কেউ কাউকে হত্যা করলে সে দুনিয়ার সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করল আর কেউ কারো প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন পৃথিবীর সমগ্র মানবগোষ্ঠীকে প্রাণে রক্ষা করল।’ (সুরা মায়েদা: ৩২)

 

রাসুলুল্লাহ (স.) বলেন, ‘কবিরা গুনাহসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বড় গুনাহ হলো আল্লাহর সঙ্গে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করা, নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা, পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া এবং মিথ্যা কথা বলা।’ (বুখারি: ৬৮৭১, মুসলিম: ৮৮) অপর হাদিসে এসেছে- ‘আল্লাহ তাআলার নিকট পুরো বিশ্ব ধ্বংস হয়ে যাওয়া অধিকতর সহজ একজন মুসলিম হত্যা অপেক্ষা।’ (তিরমিজি: ১৩৯৫; নাসায়ি: ৩৯৮৭; ইবনু মাজাহ: ২৬৬৮) অন্যায় হত্যাকাণ্ডের কারণে আল্লাহর রহমত উঠে যায়। রাসুল (স.) ইরশাদ করেন, ‘একজন প্রকৃত মুমিন তার দ্বীনের ব্যাপারে পূর্ণ আজাদ ও প্রশান্ত থাকে, যে পর্যন্ত সে অবৈধ হত্যায় লিপ্ত না হয়।’ (বুখারি: ৬৮৬২) নিরপরাধ মানুষ হত্যাকারী, প্রাপ্তবয়স্ক বিবাহিত ব্যভিচারী, ধর্মদ্রোহী ও যুদ্ধের ময়দানে কাফেরদের হত্যা করা ব্যতীত ইসলামে সব রক্তপাত নিষিদ্ধ। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আপনি বলুন, এসো, তোমাদের ওপর তোমাদের প্রতিপালক যা হারাম করে দিয়েছেন, তা তেলাওয়াত করি যে তোমরা তাঁর সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক করবে না এবং মা-বাবার প্রতি অনুগ্রহ করবে আর দারিদ্র্যের ভয়ে তোমাদের সন্তানদের হত্যা করবে না। আমিই তোমাদের রিজিক দিই এবং তাদেরও। আর অশ্লীল কাজের নিকটবর্তী হবে না, যা প্রকাশ পায় এবং যা গোপন থাকে তা থেকে। আর বৈধ কারণ ছাড়া তোমরা সে প্রাণকে হত্যা করো না- আল্লাহ যা হারাম করেছেন। এসব আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তোমরা বুঝতে পারো।’ (সুরা আনআম: ১৫১)

 

চূড়ান্ত বিচারের দিনে অন্যায় হত্যাকাণ্ডের মোকদ্দমা দিয়েই বিচারকার্য শুরু হবে। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘কেয়ামতের দিন মানুষের মধ্যে সর্বপ্রথম যে মোকদ্দমার ফায়সালা হবে তা হলো, রক্তপাত বা হত্যা সম্পর্কিত।’ (বুখারি: ৬৩৫৭) মানবতার লালন ও সংরক্ষণের প্রতি ইসলামের এতই সুস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি যে যুদ্ধাবস্থায়ও সে মানবাধিকারের প্রতি পুরোপুরি লক্ষ রাখার শিক্ষা দেয়। প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রা.) যখন সিরিয়ায় সেনা পাঠান তখন তাদের ১০টি নির্দেশ দিয়ে দেন। সে নির্দেশ ছিল এই—

 

১. নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের কেউ যেন হত্যা না করে। ২. লাশ যেন বিকৃত করা না হয়। ৩. আশ্রম, প্যাগোডা ও কুঠরিতে উপাসনারত সন্ন্যাসী ও তপস্বীদের কষ্ট দেওয়া যাবে না। কোনো উপাসনালয় ভাঙা যাবে না। ৪. ফলবান বৃক্ষ যেন কেউ না কাটে এবং ফসলের ক্ষেত যেন পোড়ানো না হয়। ৫. জনবসতিগুলোকে (সন্ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে) যেন জনশূন্য না করা হয়। ৬. পশুদের যেন হত্যা করা না হয়। ৭. প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা চলবে না। ৮. যারা আনুগত্য স্বীকার করবে তাদের জানমালকে মুসলমানদের জানমালের মতো নিরাপত্তা দিতে হবে। ৯. গণিমতের সম্পত্তি যেন আত্মসাৎ করা না হয়। ১০. যুদ্ধে যেন পৃষ্ঠ প্রদর্শন করা না হয় (মুসান্নাকে ইবনে আবি শায়বাহ: ষষ্ঠ খণ্ড, পৃ: ৪৮৭-৪৮৮)

 

নিরপরাধ মানুষকে যেভাবেই হত্যা করা হোক না কেন, দুনিয়াতে এর শাস্তির বিধান রয়েছে। আর সেটি হলো কিসাস, অর্থাৎ হত্যার পরিবর্তে হত্যা। কিসাসের ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের জন্য হত্যার ব্যাপারে কিসাসের বিধান লিখে দেওয়া হয়েছে। স্বাধীন ব্যক্তি হত্যা করে থাকলে তার বদলায় ওই স্বাধীন ব্যক্তিকেই হত্যা করা হবে। দাস হত্যাকারী হলে ওই দাসকে হত্যা করা হবে, আর নারী এই অপরাধ সংঘটিত করলে সেই নারীকে হত্যা করে এর কিসাস নেওয়া হবে। তবে কোনো হত্যাকারীর সাথে তার ভাই যদি কিছু কোমল ব্যবহার করতে প্রস্তুত হয় তাহলে প্রচলিত পদ্ধতি অনুযায়ী রক্তপণ দানের ব্যবস্থা হওয়া উচিত এবং সততার সাথে রক্তপণ আদায় করা হত্যাকারীর জন্য অপরিহার্য। এটা তোমাদের রবের পক্ষ থেকে দণ্ড হ্রাস ও অনুগ্রহ। এরপর যে ব্যক্তি বাড়াবাড়ি করবে তার জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।’ (সূরা বাকারা: ১৭৮) মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা সেই জীবনকে হত্যা করো না, যা আল্লাহ হারাম করেছেন- সংগত কারণ ছাড়া। যে অন্যায়ভাবে নিহত হয়, আমি অবশ্যই তার অভিভাবককে (মৃত্যুদণ্ড, অর্থদণ্ড বা ক্ষমার) অধিকার ও ক্ষমতা দান করেছি। সুতরাং এ ব্যাপারে সে যেন সীমা লঙ্ঘন না করে। নিশ্চয়ই সে হবে সাহায্যপ্রাপ্ত।’ (সুরা বনি ইসরাইল: ৩৩)

 

দুনিয়ার শাস্তি ভোগ করার পরও পরকালে অন্যায় হত্যাকারীর জন্য রয়েছে ভীষণ শাস্তি। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘কোনো মুমিনের জন্য সমীচীন নয় যে সে অন্য মুমিনকে হত্যা করবে, অবশ্য ভুলবশত করে ফেললে অন্য কথা।…আর কেউ স্বেচ্ছায় কোনো মুমিনকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম, সেখানে সে চিরকাল অবস্থান করবে। আর আল্লাহ তার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়েছেন ও তাকে অভিশপ্ত করেছেন এবং তার জন্য ভীষণ শাস্তি প্রস্তুত করে রেখেছেন।’ (সুরা নিসা: ৯২-৯৩)

 

আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, ‘(রহমানের বান্দা তারাই) যারা আল্লাহর সঙ্গে অন্য উপাস্যের ইবাদত করে না, আল্লাহ যার হত্যা অবৈধ করেছেন, সংগত কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করে না এবং ব্যভিচারে লিপ্ত হয় না। যারা এ কাজ করে, তারা শাস্তির সম্মুখীন হবে। কেয়ামতের দিন তাদের শাস্তি দ্বিগুণ হবে এবং তথায় লাঞ্ছিত অবস্থায় চিরকাল বসবাস করবে।’ (সুরা ফুরকান: ৬৮-৬৯)

 

হাদিস শরিফে এসেছে- ‘হত্যাকৃত ব্যক্তি কেয়ামতের দিবসে হত্যাকারীর মাথার অগ্রভাগ নিজ হাতে ধরে এমনভাবে নিয়ে আসবে যে হত্যাকারীর গলার রগসমূহ থেকে রক্ত প্রবাহিত হতে থাকবে। তখন হত্যাকৃত ব্যক্তি এ কথা বলতে বলতে হত্যাকারীকে আরশের কাছে নিয়ে আসবে ‘হে প্রভু! সে আমাকে হত্যা করেছে।’ (মুসনাদে আহমদ: ২৫৫১, তিরমিজি: ২৯৫৫)

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২১৩
১৪১৫১৬১৭১৮১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
২৮২৯৩০  

All Rights Reserved ©2024