শনিবার, ৫ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

“একজন মানুষের গল্প”

             লেখক: সারওয়ার চৌধুরী (যুক্তরাষ্ট্র)

আমি আপনাকে আপনার নিজের বাড়িতে নিয়ে যাব — আমার কথা শুনে সত্তোর্ধ বৃদ্ধ রহমান সাহেব ফ্যাল ফ্যাল করে তাকালেন আমার দিকে, উনার চিন্তায় হয়তো উকিঝুকি মারছে, বোধহয় উনাকে নিয়ে মশকরা করা হচ্ছে !

আমাকে চিনেছেন ? বিশ বছর আগে, দশ এগারো বছরের একটা ছেলে, যার মা একটা এক্সিডেন্টে মারা যাওয়ার পর বাবা আরও একটা বিয়ে করেন, সৎমা ছেলেটিকে কখনও সহ্য করতে পারতেননা, ঠিকমত খাবার দিতেননা, তখন বাধ্য হয়ে ছেলেটা মানুষের কাছে হাত পাততো ! একদিন রাস্তার মাঝে যখন সবাই চোর ভেবে ছেলেটাকে পিটাচ্ছিল, যখন কেউ তার কথা বিশ্বাস করছিলনা তখন আপনি তার কথায় বিশ্বাস করেছিলেন, আপনি স্নেহের হাত প্রসারিত করে তাকে একটা এতিমখানায় ভর্তি করে দিয়েছিলেন, তিন বছরের জন্যে তার যাবতীয় খরচ একসাথে পরিশোধ করে একটা ফোন নাম্বার দিয়ে এতিমখানা কর্তৃপক্ষকে বলেছিলেন প্রয়োজন হলে তারা অবশ্যই যেন আপনার সাথে যোগাযোগ করেন ! আপনার সেই মহানুভবতার ফলশ্রুতিতে ছেলেটা একটা স্বাভাবিক জীবন পায় ! এতিমখানায় ভর্তি হয়ে সে পড়ালেখায় খুব মনযোগ দিল, একের পর এক বৃত্তি পেয়ে দেশের গন্ডি পেরিয়ে ইংলেন্ডের একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলারশীপ পেয়ে ব্যবসার উপর পড়ালেখা শেষ করে সে এখন পুরোপুরি ব্যবসায়ী, দেশে বিদেশে বেশ কয়েকটা ব্যবসা ! মনে পড়ছে আপনার ?

আমি ই সেই ছেলে, ব্যবসার পাশাপাশি মনের তাগিদে এই বৃদ্ধাশ্রম করেছি, যে সকল বয়স্ক মানুষের শেষ কোন আশ্রয়স্থল থাকেনা, যাদের এখানকার খরচ যোগানোর কেউ থাকেনা, তাদের কাছ থেকে একটু খোঁজ খবর নিয়ে চেষ্টা করি বিনা খরচে এখানে রাখতে !

গত চার বছর ধরে আপনি এখানে আছেন, আপনার স্ত্রী মারা গেছেন, আপনার সন্তানেরা আপনাকে এখানে রেখে গেছে ।

বেশ কয়েকমাস থেকে সন্তানেরা যখন আপনার খরচ দেয়া বন্ধ করে দিল তখন খোঁজ নিয়ে আমি এমন একজন মানুষের সন্ধান পেলাম,যাকে আমি খোঁজে বেড়াচ্ছি বিশ বছর ধরে।

আমাকে এতিমখানায় ভর্তি করিয়ে আপনি কিন্তু কোন ঠিকানা দিয়ে যাননি, শুধু একটা ফোন নাম্বার দিয়েছিলেন, গত পাঁচ বছর ধরে আমি চেষ্টা করছি, কিন্তু কেউ ফোনটা ধরেনা, বোধহয় আপনি নাম্বারটা বদলে ফেলেছেন, তবে হৃদয় দিয়ে খোঁজেছি আপনাকে, বিশ্বাস ছিল মনে, একদিন অবশ্যই খোঁজে পাব, আপনাকে বুকে জড়িয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার সুযোগ পাব ! আজ বোধহয় আমার সেই সুযোগটা এসেছে।

রহমান সাহেব আনমনে আমার কথা শুনছিলেন, গত এক বছরে উনার সন্তানদের কেউ এসে উনার কোন খোঁজ খবর নেয়নি, তবে আগেও তারা নিয়মিত আসতোনা, তিন চার মাস পরপর আসতো, রহমান সাহেবকে এখানে রেখে ওরা যেন অনেকটাই বেচে গেছে, ওনি যেন তাদের কাছে বোঝায় পরিণত হয়েছিলেন।

খোঁজ খবর নিয়ে আমি জানতে পারি, আপনার সন্তানেরা ব্যবসায় লোকসান করে দেনা গ্রস্থ, বাড়ি বিক্রি করতে চাচ্ছিল, আপনার বাড়িতে গিয়ে আপনার একটা পুরোনো ছবি দেখে আমি এমন একজন মানুষের কথা জানতে পারলাম যাকে আমি এতদিন ধরে খোঁজে বেড়াচ্ছি, আর উনি কি না আমারই আশ্রয় কেন্দ্রে আছেন গত চার বছর ধরে। তখনই আমি আপনার বাড়ি আপনার ছেলেদের কাছ থেকে উদ্ধার করেছি, যারা আমাকে জানিয়েছিল তাদের পিতা মারা গেছেন, আপনার মত পিতা সম্পর্কে সন্তানেরা একথা কি করে বলতে পারে ? কিভাবে আপনাকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে ?

আমার একটানা কথাগুলো শুনে কখন যে রহমান সাহেবের চোখ দুটো ভিজে একাকার,খেয়ালই হয়নি, একটানে আমাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন, কান্না জড়ানো কন্ঠে উনি বলছিলেন ,“এখনো পৃথিবীতে এমন মানুষ আছে, এখনো পৃথিবীতে ভালবাসা আছে, শ্রদ্ধা ভক্তি আছে, আছে দায়িত্ব পালনের দায়বদ্ধতা। নিজের সন্তানদের জন্যে কতকিছু করলাম, নিজের সবকিছু উজাড় করে দিলাম, সেই সন্তানেরাই শেষ বয়সে আমাকে ছুড়ে মারলো, আর পথ থেকে তুলে যার জন্যে সামান্য মানবতা দেখালাম সে ই আজকে আমার এই কঠিন সময়ে আমার পাশে এসে দাড়ালো, আমাকে বুকে টেনে নিল!”

আপনি যদি সেদিন আমাকে উদ্ধার করে এতিমখানায় দিয়ে না আসতেন, আমার ব্যয়ভার গ্রহণ না করতেন তবে হয়তো আমি সত্যি সত্যি চোর ডাকাত কিংবা সন্ত্রাসী হয়ে বেড়ে উঠতাম, সকল মানুষকে ঘৃণা করতাম ! আপনার মত মানুষের শেষ বয়সটা কখনও এমন হতে পারেনা, আমার বাবার আমার জন্যে যেটা করার কথা ছিল আপনি তা থেকেও অনেক বেশী করেছেন, আপনার মত মানুষের কারনেই পৃথিবীতে এখনো মানবতা ঠিকে আছে, আপনি তো আমার কাছে ফেরেশতা সমতুল্য, আমার সৌভাগ্য যে আমি আপনাকে খোঁজে পেয়েছি।

আমি রহমান সাহেবকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম অঝোরে ধারায় ভাসছিল আমার চোখ দুটো, রহমান সাহেবও নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেননা, উনারও চোখ দুটো ভেসে যাচ্ছে, আমাকে আরও শক্তভাবে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, এক স্বর্গীয় আবেশে দুজনই মোহিত, কয়েকদিন আগেও যে পৃথিবীর উপর রাগ ছিল সীমাহীন, সেটা নিমিষেই দূর হয়ে গেল রহমান সাহেবের।

রহমান সাহেবের মত মানবিক বোধ সম্পন্ন মানুষেরা আছে বলেই হয়তো পৃথিবীটা এখনও ঠিকে আছে, আমার মত নিরাশ্রয় নিরুপায় মানুষেরাও এই পৃথিবীতে এখনও বেচে থাকার স্বপ্ন বোনে, তাদের স্বপ্নগুলো সত্যি হয়, অথচ শত সহস্র রহমান সাহেবের শেষ বয়সের খবরটা আমরা জানিনা কিংবা জানার বিন্দুমাত্র চেষ্টাও করিনা।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১
১৩১৫১৬
১৯২০২১২২২৩২৪২৫
২৬২৭৩০৩১