বৃহস্পতিবার, ১৪ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

ঐতিহ্যে ভরা সিলেটের চা শিল্প

“মমতাবিহীন কালস্রোতে /বাঙলার রাস্ট্র সীমা হোতে নির্বাসিতা তুমি,সুন্দরী শ্রীভূমি”কবিগুরু রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর একবার সিলেটে ভ্রমন করতে এসে এভাবেই উক্তি করেছিলে।বহুদিন থেকে সিলেটে একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে” শ্রীহট্টে মধ্যমা নাস্তি”অর্থাৎ সিলেটের লোকেরা সকল ক্ষেত্রেই উত্তম পর্যায়ের।পৃথিবীতে অনেক কিছুই দু চোখ দিয়ে দেখা হলেও
অন্তর দৃষ্টিতে সব সময় দেখা হয়না।বৃহত্তর সিলেটে জন্ম গ্রহন করেও দুটি পাতা একটি কুড়ির বিভাগ সিলেটকে দেখা হয়নি হৃদয় খুলে।এমন কি চা বাগান থেকে মাত্র চার কিলোমিটার দূরত্বে বসবাস করেছি এক দশকের ও বেশী সময়,কখন ও চা বাগানের আঙ্গিনা মাড়াইনি।বিদেশ বিভূইয়ে নিকট আত্মীয়রা প্রবাসী হওয়ার সুবাদে চা বাগানের পাশ দিয়ে এয়ারপোর্ট রোডে যে কতবার মাড়িয়েছি তার ইয়ত্তা নেই।প্রবাসী স্বজনদের আগমনে ফুরফুরে আনন্দে ভরা থাকতো মনটা।চা বাগানের পাশ দিয়ে যেতে যেতে দারুণ এক আকর্ষণে বিমোহিত হতাম।আবার প্রবাসীদের বিদায় জানাতে সেই একই রাস্তা, সেই মালনিছড়া,সেই লাক্কাতুরা,দুটি পাতা একটি কুঁড়ির সবুজায় ঘেরা সুন্দর পরিপাটি চা বাগানের বিস্তৃত এলাকা টিলায় টিলায় সমৃদ্ধ।দুঃখে ভারাক্রান্ত মনে অনেক ছায়া বৃক্ষের কান্না শুনতাম।এমনি করেই চা পাতার কুঁড়ি স্পর্শ করার আখাংকা
মন ও মননে থেকেই গেল।তিন দশকের ও বেশী সময় হলো আমি ও প্রবাসী।শিকড়ের টানে সল্প সময়ের জন্য দেশে যাওয়া হয়।দেশে জনজীবনের পরিবর্তন দেখে অবাক হই,আবার ক্ষুধার্ত মানুষ গুলোর দুঃখে আহত হয়ে সব কিছু বিলিয়ে দেবার ইচ্ছে প্রকাশ করি।আমার মতো পরিবারের সবাই মিস করে সিলেট কে।সিলেটের বিখ্যাত স্থাপনা সহ বিশাল চা বাগানকে।২০১৯ সালের ডিসেম্বরে পরিবারের সবাইকে নিয়ে দেশে গেলাম, সবাই চা বাগান দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করলো।এখন এই চা বাগানকে ঘিরে গড়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন কেন্দ্র,বিরাট পরিসরে গড়ে উঠেছে খেলার মাঠ সবই শুনা কথা দেখা হয়নি তাই আমি ও ভাবলাম এ সুযোগ হাতছাড়া করা যাবেনা।
সুনামগন্জ থেকে গাড়ি নিয়ে চলেগেলাম সিলেট তথা বাংলাদেশের সর্ব প্রথম প্রতিষ্টিত মালনিছড়া চা বাগানে।চা বাগান দেখার অভিপ্রায়ে প্রথমেই থমকে গেলাম শ্রমিকদের সামনে।চা শ্রমিকদের দাবী তাদেরকে একটা ফি দিতে হবে,তারপর ওরা নির্ধারিত জায়গা গুলো দেখাবে।আমরা রাজি হলাম।একজন চা শ্রমিক সবাইকে রাস্তা দেখিয়ে আগে আগে চলতে লাগল,আমরা তাকে অনুস্মরণ করে হাঁটছি,ছোট বড় টিলার  সমন্বয়ে কখনো নিচু পথে কখনো উঁচু পথ মাড়িয়ে শ্রমিক বস্তির সামনে গিয়ে থামলো লোকটা।ওখানে ছোট্ট চালা ঘরে চা য়ের পসরা নিয়ে বসে আছে এক টেরা চোখি চা শ্রমিক মহিলা।বাঁশের তৈরি ব্যঞ্চে বসা ছিল দুজন চা শ্রমিক আমরা যাওয়ার পরেই লোক গুলো তরিগড়ি করে উঠে গেল।ভাবলাম ব্যবসাটা মন্দ না।জিজ্ঞেস করে জানলাম তাদের কাছে নিজস্ব প্রক্রিয়ায় তৈরি গ্রীন টি ও আছে।রেগুলার চা তো নশ্যি।ভর দুপুরে কোন্ চা খাবো,কোনোটাই যেন রুচিতে যাচ্ছে না।পরে কিছুক্ষন বসার খেসারৎ হিসেবে কয়েক কাপ লাল চায়ের অর্ডার দিয়ে চা শ্রমিক লোকটার সাথে অনেক -ক্ষন গল্পে মেতে উঠলাম।চা শ্রমিকদের জীবন ধারার অনেক গল্প শোনা হলো।শুনে অবাক হলাম, শ্রমিক লোকটার মুখে কোন দুঃখের কাহিনী বের হলনা।এতক্ষনে পরিবারের অন্যরা ফটোসেশনে অনেক ব্যস্থ সময় কাটিয়ে দিল।
প্রাচীন কালে চীনদেশে বিখ্যাত পানীয় ছিল চা। চীনে টি এর নাম ছিল চি। পরে হয়ে যায় চা।পরবর্তিতে চা হয়ে যায় বিশ্বের সর্বাধিক প্রসংশিত পানীয়।বৃটিশরা চা য়ের সুখ্যাতি দেখে চীন থেকে চুরি করে নিয়ে আসে ২০হাজার চারা।ভারতের দার্জিলিং পাহাড়ে এবং চট্রগ্রামে এ সব চারা রোপন করে পরিক্ষামোলক ভাবে বাগান তৈরি করে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী।যা বৃটিশ রাবাবি বলে ও খ্যাত।পরবর্তীতে ভারতের আসাম হয়ে সিলেটে গড়েউঠা প্রথম মালনিছড়া চা বাগান নামে বানিজ্যিক ভিত্তিতে বেছে নেয় ইষ্টইন্ডিয়া কোম্পানী।কথিত আছে,বৃটিশরা সিলেট বাসীকে বিনা মূল্যে চা বিতরণ করে চা পান করাতে অভ্যস্ত করলে ও এখন দেশের একমাত্র বিখ্যাত পানীয় চা।১৮০০ শতাব্দির প্রথম ভাগে আসাম ও তৎসংলগ্ন এলাকায় চা চাষ শুরু হয়।তারই ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামের কর্নফুলি নদীর তীরে ১৮২৮ খৃষ্টাব্দে জমি বরাদ্দ করে চা চাষের উপযোগী করা হয়,কিন্তু এই প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি।পরবর্তিতে চট্রগ্রাম ক্লাব সংলগ্ন একটি চা বাগান প্রতিষ্টিত করা হয়।কিন্তু অল্পদিনে বিলুপ্ত হয়ে যায় সেই চা বাগান।অতপর ১৮৫৪ সালে সিলেটের এয়ারপোর্ট রোডে মালনিছড়া চা বাগান বানিজ্যিক ভাবে প্রতিষ্টিত হয়।মূলতঃ এটাই সিলেট তথা বাংলাদেশের প্রথম চা বাগান।
চা বলতে সাধারণত আমরা বুঝি এক ধরনের ক্যামেলিয়া সিনেনসিস নামক উদভিদের পাতা থেকে যে পানীয় তৈরি করা হয়, তাতে এক ধরনের প্রশান্তিদায়ক স্বাদ রয়েছে যার দরুন সবার কাছেই গ্রহন যোগ্য।কিন্তু সব চায়ে এই প্রশান্তিদায়ক স্বাদথাকে না।চাকে বিভিন্ন প্রকারের প্রস্তুত ভেদের কারনে গুনের যে তারতম্য ঘটে তা হয়ত আমরা অনেকেই জানিনা।প্রস্তুত প্রনালীতে এক এক ধরনের চা এক এক স্বাদ যুক্ত হয়।কিছু কিছু চা ঔষধ হিসেবে ব্যবহার হয়।যেমন ক্যামামেল টি তে কোন ক্যাফিন না থাকায় নিদ্রা জনিত সমস্যায় খুবই উপকারী।ভেষজ চা এক ধরনের উদ্ভিদের পাতা,ফুলও ফল থেকে উৎপাদিত হয় বলে এতে কোন ক্যাফিন থাকেনা।বর্তমান পৃথিবীতে অনেক ধরনের চা উৎপন্ন হচ্ছে,লাল চা ,কালো চা,সবুজ চা,সাদা চা।
সিলেটের শ্রীমঙ্গলের চা বাগানে প্রায় সাত প্রকার চায়ের মিশ্রনে এক বিলাসবহুল চা তৈরি করা হয়।দূরদারান্ত থেকে লোকজন আসে চায়ের স্বাদ নিতে।বাংলাদেশে চা বাগানের মধ্যে একমাত্র সিলেট বিভাগেই আছে ১৪৮ টি চা বাগান।অর্থাৎ ৯0 ভাগ চা বাগান সিলেটেই।বাকি ১০ ভাগ চট্রগ্রাম বিভাগে।প্রায় সকল চা বাগান বৃটিশ আমলে নির্মিত চা বাগান গুলোতে প্রায় ৯০ হাজার শ্রমিক স্থায়ী ভাবে কাজ করে।সিলেটের চা পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশ গুলিতে রফতানি হয়ে থাকে বলে ‘সিলেটি টি’হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে।লন্ডন প্রবাসী একজন সিলেটি উদ্যোগক্তার টি হাউসে পৃথিবীর অনেক গুলো দেশের উৎপাদিত প্রায় ১১৬ ধরনের চা তাঁর সংগ্রহে আছে।বৃটিশ প্রক্তন প্রধান মন্ত্রী মারগারেট থেচার সহ বৃটিশ পার্লামেন্টের অনেক গুনিজন সিলেট টি হাউসের চায়ের স্বাদ নিয়েছেন ১৮০০ সালের পর থেকে দিনের পর দিন চায়ের ইতিহাস বারতেই থাকল।সাথে চাখুড় মানুষের সংখ্যাও।দেশের রাস্তার পাশের পানের দোকানে ও এক পাশে বসানো থাকে ফটন্ত জলের বড় কেটলি।পথচারী লোকজন চায়ের স্বাদ নিচ্ছে বিভিন্ন রুচিতে কেউ চায় দুধ চা,কেউ আদা চা,কেউবা চিনি ছাড়া লাল চা।চায়ের প্রতি ভিন্ন মানুষের চাহিদা ভিন্ন।মেহমান আপ্যায়নে চায়ের সাথে টা ও থাকে,সাথে জিরা কাটা সুপারি দিয়ে পানদান।সবই মূলত চায়ের সাথে সম্পর্ক যুক্ত।
পরিশেষে বলতে হয় আপনার দিন শুরু হোক এক কাপ চায়ে আপনার নিজস্ব স্বাদের চা নিয়ে।চাইলে বলা যায় গানের সুরে,” এক কাপ চায়ের সাথে তোমাকে চাই”।নান্দনিক কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমদ ও চায়ের স্তুতি করেছিলেন তাঁর উষ্নতার মাপকাঠিতে,” এক কাপ উষ্ন চা একজন ভাল বন্ধুর মত”স্বাদে হোক,গন্ধে হোক,উষ্নতায় হোক,চায়ের কাপে ধোঁয়া উঠুক,বয়ে যাক যত তর্কের ঝড় বয়ে যাক চায়ের দোকানের বন্ধুদের সাথে।
             লেখকঃ আবদুস শহীদ (যুক্তরাষ্ট্র)

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১৩১৫
১৬১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭
৩০