লেখকঃ মোহাম্মদ অলিদ সিদ্দিকী তালুকদার (বাংলাদেশ)
ছোট-বড়, সাময়িক মিলিয়ে নানা ধরনের সংকটকে সঙ্গী করেই চলতে হয় গণমাধ্যমকে।অন্যভাবে বলা হয়, সংকট বা দুর্গতি নিয়েই গণমাধ্যমের জন্ম। যুদ্ধ-মহামারিসহ কালে কালে নানা ধরনের সংকট-দুর্যোগ মোকাবেলা করেই টিকে ছিল সংবাদপত্র।গণমাধ্যমকর্মীরাও এতে অনেকটা অনেকটা অভ্যস্ত।কিন্তু, সংকটের এই চলতি পথে করোনা মহামারি গণমাধ্যমকে যে মাত্রায় কাবু করেছে তা গোটা বিশ্বেই নজিরবিহীন।এক অবর্ণনীয় অবস্থা।বলার অপেক্ষা রাখে না, সাংবাদিকতা পেশাটি এমনিতেই অনেক বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।আর বর্তমান বৈশ্বিক মহামারীতে বিপর্যস্ত অর্থনীতির মাঝে বিচ্ছিন্ন কর্মক্ষেত্রে প্রকৃত এবং ঘটনার অন্তরালের খবর তুলে ধরা একজন সাংবাদিকের জন্য অনেক বেশি জটিল এবং দুরূহ হয়ে উঠেছে।করোনাতে আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা কত,কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার হলো কি না,হলে কবে হবে, টেস্টিং সেন্টার কোথায়,দেশ থেকে দেশান্তরের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎটা কেমন- ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর জানতে মানুষ যখন মরিয়া, ঠিক তখনই মানুষ সৃষ্টির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুর্যোগে আক্রান্ত গণমাধ্যম দুনিয়াও।ত মাস কয়েকে করোনার ঝাপটায় গোটা বিশ্বের পত্রিকা,টেলিভিশনসহ গণমাধ্যমগুলো কল্পনাতীত নাজুকদশায় পড়েছে।কেবল বেকার নয়, চাকরিরত গণমাধ্যমকর্মীরাও কঠিন সময় পার করছেন। চাকরি হারানো বা বেতন নিয়ে করোনার আগে থেকেই সামগ্রিকভাবে গণমাধ্যমগুলোতে এই সংকট ছিল।করোনার মতো মহামারির সময়ে এসে সংকট আরো প্রকটতর রূপ নিয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের উল্লেখযোগ্য কোনো সহযোগিতা ছাড়াই দেশের গণমাধ্যমকর্মীরা নিজেদের ও পরিবারের স্বাস্থ্যঝুঁকির দিকে না তাকিয়ে করোনা সংক্রান্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও সংবাদ সরবরাহে নিয়োজিত।সরকারি পর্যায়ে প্রায় একলক্ষ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করলেও সে তালিকায় নেই গণমাধ্যম।উপরন্তু, তাদের বোনাস হিসেবে জুটছে চাকরিচ্যুতি। এতো কিছুর পরেও করোনার ঝুঁকি নিয়ে তারা কাজ করছেন ফ্রন্টলাইনের যোদ্ধার মতো।এই পর্যন্ত ৫১৩ জন গণমাধ্যমকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মৃত্যুবরণ করেছেন ১২ জন সাংবাদিক।উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন ৯ জন গণমাধ্যমকর্মী। গণমাধ্যমকর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করলেও তাদের পেশাজীবী সংগঠন ও নিয়োগকারী কতৃপক্ষের কাছে সাংবাদিক আক্রান্ত ও মৃত্যুর কোনো অফিসিয়াল তথ্য নেই।এ বিষয়ে তাদের দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগও নেই। ছাঁটাই, বাধ্যতামূলক ছুটি, বেতন বন্ধ-বকেয়া মিলিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় গণমাধ্যমকর্মীরা।এই যখন অবস্থা তখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো চেপে বসেছে।আইন ও সালিশ কেন্দ্র আসকের পরিসংখ্যান অনুসারে গত ছয় মাসে ১৫৬ জন সাংবাদিক নির্যাতন, হয়রানি, হুমকি ও পেশাগত কাজ করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়েছে।আসকের তথ্যানুযায়ী, করোনাকালে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। সরকারের যতো আগ্রহ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দিকে। এদিকে-ওদিকে সাংবাদিক নামের নিরীহ জীবদের দিকে। ধরার আগে,অভিযোগের যৌক্তিকতার বিষয়ে কোনো কথা বলা হচ্ছে না। ‘ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হওয়া’,’গুজব ছড়ানো’, অথবা ‘সরকারের সমালোচনা’ করার মতো কারণকে সাংবাদিকদের জেলে ভরতে যথেষ্ট মনে করার উম্মাদনা বাজে ইঙ্গিত দিচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা মানেই বেশিরভাগক্ষেত্রে এখন গ্রেপ্তার হওয়া।বিদ্যমান মানহানির মামলার পরিবর্তে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা ঠোকার মধ্যে সাংবাদিকদেও ভয় দেখানো ও হয়রানির মানসিকতা স্পষ্ট। মামলা ছাড়াও সাংবাদিকদের টুটি চেপে ধরা খুব সোজা কাজ। মার দেয়াও কোনো বিষয় নয়।যে ইচ্ছা সেই করতে পারে। এর কোনো বিচার বা বিহিত হয় না।কার্যকর প্রতিবাদও হয় না। ভালো নেই গণমাধ্যমের মালিকরাও।মাঝারি এবং ছোট অনেক পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেছে।যেগুলো কোনো মতে টিকে আছে সেগুলোর সার্কুলেশন কমতে কমতে তলানিতে চলে এসেছে। সরকারি বিজ্ঞাপন কমেছে। প্রাইভেট বিজ্ঞাপন নেই বললেই চলে।বিজ্ঞাপনের বকেয়া বিলের স্তূপ পড়েছে। টেলিভিশনগুলোর আয়ের একমাত্র অবলম্বন বিজ্ঞাপনে চরম খরা। ক্ষেত্রবিশেষে টেলিভিশনগুলো পত্রিকার চেয়ে খারাপ সময় পার করছে।নাটক, টেলিফিল্ম কিছুই নেই। বিশ্বের দেশে-দেশে চিত্র প্রায় এমনই। ব্রিটেনে এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে ম্যানচেস্টার টাইম, গ্লোবাল রিমার্ক, ফোকাস দ্য নিউজসহ কমপক্ষে ২০টি পত্রিকা।যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসএ টুডে-সহ শতাধিক স্থানীয় পত্রিকার স্বত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠান গ্যানেট জানিয়েছে, তারা ঋণ কমাতে রিয়েল এস্টেট বিক্রি করে দিচ্ছে এবং শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ প্রদান স্থগিত করেছে। দেশটির নিউজ পোর্টালগুলোতে বিজ্ঞাপনের হার কমে গেছে ৫০ শতাংশ। কোভিড-১৯ পরিস্থিতির ক্রমাবনতিতে রুপার্ট মারডকের অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়া গ্রুপ নিউজ কর্পোরেশন জানিয়েছে, তাদের আঞ্চলিক ৬০টি সংবাদপত্রের ছাপা বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে।ছাপা সংস্করণ বন্ধ করে অনলাইনে যাওয়ার পথে নিউ সাউথ ওয়েলস, ভিক্টোরিয়া, কুইন্সল্যান্ড-এর মতো পত্রিকাগুলো। অনলাইন পোর্টালগুলোও এর বাইরে নয়। মহামারিতে দুস্থ মানুষগুলোর মতোই গণমাধ্যমকেও বাঁচাতে ত্রাণ সরবরাহের আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম মিডিয়া ট্রেড গ্রুপ, প্রকাশক এবং ব্রডকাস্টারের মতো অনেক সংগঠন। ক্ষতিগ্রস্ত গণমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে ৯১ মিলিয়ন ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে অস্ট্রেলীয় সরকার।এতে ৪১ মিলিয়ন ডলারের করছাড় এবং ‘রিজিওনাল জার্নালিজম প্রোগ্রামের’ আওতায় আরও ৫০ মিলিয়ন ডলার অর্থসহায়তা দেয়া হচ্ছে। গণমাধ্যমের জন্য প্রায় ২৭ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দের চিন্তা-ভাবনা করছে ডেনমার্ক সরকার।বাংলাদেশে এ ধরনের পদক্ষেপের দাবি থাকলেও আশাবাদী হওয়ার অবস্থা এখনো নেই। নানা বাধা-জটিলতার মধ্যেও গত দুই দশকে বাংলাদেশে গণমাধ্যমে একটা নীরব পরিবর্তন এসেছিল। বেসরকারি টেলিভিশন-রেডিও’র সংখ্যা অনেক বেড়েছে। এখন ৩০টি বেসরকারি টেলিভিশন চালু রয়েছে।সম্প্রচারের অপেক্ষায় আরো ১৫টি। ২৬টি বেসরকারি রেডিও চালু রয়েছে। প্রত্যেক জেলায় রয়েছে কমিউনিটি রেডিও। সরকারি বিজ্ঞাপন তালিকাভুক্ত জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকার সংখ্যা ৭০৭টি।এর মধ্যে ঢাকা থেকে প্রকাশিত ৩৬৫টি, মফস্বল থেকে প্রকাশিত ৩৪৭টি পত্রিকা সরকারি বিজ্ঞাপন পেয়ে থাকে ।এর মধ্যে দৈনিক রয়েছে ৫১২টি।এগুলোতে অনেকের কর্মসংস্থান হয়েছে ।বর্তমানে হাতে গোনা কয়েকটি পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল নিয়মিত বেতনভাতা পরিশোধ করছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্রের বিভিন্ন বিভাগে কর্মী ছাঁটাই করা হয়েছে ।নিয়মিত বেতন হয় না বেশিরভাগ টেলিভিশন ও সংবাদপত্রে।কোনো কোনো গণমাধ্যম তাদের সিনিয়র সাংবাদিকদের বিনা বেতনে ছুটি দিয়ে অপেক্ষাকৃত জুনিয়র ও শিক্ষানবিশ কর্মী দিয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।কিছু পত্রিকা আবার তাদের সংবাদকর্মীদের বেতন – ভাতাদী অর্ধেকে নেমে এনেছে ।মফস্বল থেকে প্রকাশিত গণমাধ্যম ও সংবাদকর্মীদের অবস্থা আরো নাজুক ।এ ভাবে সামনের দিনগুলোতে সাংবাদিকতা পেশাটি কোন অবস্থায় পতিত হবে? মেধাবীরা এ পেশায় আসবেন কি – না? এসব প্রশ্ন ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা দেশে দূর্বল হয়ে গেলে গণমাধ্যম, উন্নয়ন ও সুশাসন আরো ঝুঁকিতে পড়বে । গণমাধ্যমের এই সংকট শুধু গণমাধ্যমের নয়, এই সংকট রাষ্ট্রেরও।তাদের সচ্ছলতা নিশ্চিত না করলে তারা রাষ্ট্রের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারবে না।প্রচলিত গণমাধ্যমের ইতিহাসে তীব্রতম সঙ্কটময় এই মুহূর্তে সরকারগুলোর নিস্ক্রিয়তায় জায়গা করে নেবে সোশ্যাল মিডিয়ার মতো অপ্রচলিত গণমাধ্যম, যার পরিণাম হতে পারে প্রাণঘাতী ভাইরাসটির চেয়েও ভয়ঙ্কর।এর গুরুত্ব বুঝতে আবারও ফিরে যেতে হয় যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জেফারসনের কাছে। তিনি বলেছিলেন সংবাদপত্রহীন সরকার আর সরকারবিহীন সংবাদপত্র দুটোর একটা বেছে নিতে হলে তিনি সরকারবিহীন সংবাদপত্রকেই বেছে নেবেন।এমন মহামারী পরিস্থিতির বিষয়ে গণমাধ্যমের আগাম আভ্যন্তরীণ প্রস্তুতি না থাকার সত্যতা লুকানোর মতো নয়।করোনায় অতিমাত্রায় গণ্ডীবদ্ধ হয়ে যাওয়ায় নিজস্ব সোর্স কমে গেছে সংবাদকর্মীদের। ফলে অন্যদের তথ্যের উপরই বেশি নির্ভর করতে হচ্ছে।এতে তথ্য যাচাইয়ের সুযোগ কমে গেছে।থমকে গেছে অনুসন্ধানী সংবাদকর্ম।তা গত ক’দিন ধরে সাংবাদিকতার তাল – লয় পাল্টে দিয়েছে।গোটা বিশ্বেই ফেসবুক, টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন জনপ্রিয়।অবস্থার অনিবার্যতায় ফেসবুক,গণমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের তফাৎ প্যাঁচিয়ে গেছে।ফেসবুকের কোনো সম্পাদক না থাকায় এর কর্তৃপক্ষ নেই।দায়িত্বশীলতাও নেই। ফেসবুকের ওয়ালে ওয়ালে ঘুরে বেড়ায় অনেক ফেক নিউজ, ভুল তথ্য, বিকৃত তথ্য।এই চাপে মূলধারার গণমাধ্যমও আক্রান্ত ।তা কেবল গণমাধ্যমের জন্য নয়, গণতান্ত্রিক সুস্থতার জন্যও খারাপ খবর॥