ইদানিং পত্র-পত্রিকা ও সোস্যাল মিডিয়ায় বেশকিছু লোভনীয় বিজ্ঞাপন সবার নজর কেড়েছে। তা হলো- আমেরিকা ও কানাডায় নাকি খুব সহজে ভিসা পাওয়ার খবর। বিশ্বের উন্নত এ দুটি দেশের ভিসাপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা দিয়ে ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা কিছু এজেন্সি হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অংকের টাকা। দেশ দুটিতে যাবার জন্য মরিয়া তরুণ ও যুব সমাজ সহায়-সম্পদ বিক্রি করে প্রতারকদের কাছে তুলে দিচ্ছেন ২০ থেকে ৪০ লাখ টাকা।
একটা সময় তাদের ভাগ্যে ভিসা জুটলেও শিকে ছিড়ছে না। বিদেশযাত্রার লোভনীয় ফাঁদে পা দিয়ে মোটা অংকের টাকা খরচ করে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় যেতে পারলেও কপালে জুটছে মানবেতর জীবনযাপন। অনেকে বছরে বছরের পর বছর পার করছে আনডকুমেন্টেড হিসাবে। মিলছে কাজ করার অনুমতি। জুটছে না ভালো কাজ। অনেকে দেশে ফিরছেন শূন্য হাতে। আর কেউ অনিশ্চিত জীবনের গ্লানি নিয়ে ধুকে ধুকে মরছেন। ফিরছেন স্বদেশের মাটিতে লাশ হয়ে।
খুব বেশী দূরের কথা নয়। এই তো সেদিনের কথা। কানাডায় বেড়াতে আসা রাশেদ তানভীরের লাশ গত ২২ নভেম্বর টার্কিশ এয়ারলাইন্সের মাধ্যমে দেশে পাঠানো হয়েছে। গত ৫ সেপ্টেম্বর তানভির (২৮) ১৯ লাখ টাকা খরচ করে ভিজিট ভিসায় এসে টরন্টোতে অ্যাসাইলাম আবেদন করেছিলেন। তিনি থাকতেন বাংলা টাউনের ডেনফোর্থ এলাকার থায়রা অ্যাভিনিউতে। বিগত আড়াই মাসে অনেকের মতো নানান সংকটে তিনি হতাশ হয়ে পড়েন এবং গত ১০ নভেম্বর হঠাৎ স্ট্রোক করে মারা যান। তার লাশ বাংলাদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করছে কানাডিয়ান বাংলাদেশি ইসলামিক ফিওনারেল।
তানভীরের গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরের কালকিনিতে। বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে ছিলেন তিনি। ঢাকা কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করে বুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে কানাডা যান। কিন্তু স্বপ্ন পুরণ হলো না তার। বাবা-মায়ের টাকা তো গেছেই, সাথে চলে গেছে অমূল্য ধন।
তানভীরের মৃত্যুর কয়েক মাস আগে অর্থাৎ চলতি বছরের এপ্রিল মাসে কানাডায় পড়তে গিয়ে লাশ হয়ে দেশে ফিরেছেন হবিগঞ্জের মাধবপুরের বাসিন্দা ইয়াসিন মোহাম্মদ খান ফাহিম (২৬)। মৃত্যুর ১৭ দিন পর তার মরদেহ উপজেলার আন্দিউড়া গ্রামে নিজ বাড়িতে পৌঁছায়। ফাহিমের লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স গ্রামে পৌঁছালে গ্রামের শত শত মানুষ তাকে এক নজর দেখতে ও শেষ বিদায় জানাতে ভিড় করেন। সেখানে স্বজনদের আহাজারিতে এক হৃদয়বিদায়ক দৃশ্যের অবতারণা হয়।
তিন বছর আগে উচ্চশিক্ষার জন্য কানাডা যান তার ছেলে ইয়াসিন মোহাম্মাদ। সেখানে তিনি মন্ট্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। এ শহরেই ডাউন টাউনের একটি অ্যাপার্টমেন্টে তিনি থাকতেন। ২৩ এপ্রিল থেকে ফাহিমের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না স্বজনরা। পরে কানাডায় অবস্থানরত ফাহিমের বন্ধু আরিফুলের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার বিষয়ে খোঁজ নিতে অনুরোধ করেন। ২৬ এপ্রিল আরিফুল তার বাসায় গিয়ে ভেতর দিয়ে দরজা আটকা দেখতে পান। অনেক ডাকাডাকির পর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে তিনি মন্ট্রিয়াল পুলিশকে খবর দেন। পরে পুলিশ এসে বাড়ির ভেতর থেকে ফাহিমের মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে নিয়ে যায়। ময়নাতদন্তের ১৭ দিন পর তার লাশ দেশে পাঠানো হয়। অর্থনৈতিব টানাপড়েনে ফাহিম দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন ফাহিম।
তানভীর ও ফাহিমের মত উঠতি বয়সের হাজারো যুবক লোভনীয় বিজ্ঞাপন দেখে ফাঁদে পড়ছে। এক এজেন্সিকে ১৯ লাখ টাকা দিয়ে কানাডার ভিজিট ভিসা করান তানভীর। তার এক আত্মীয় জানান, তানভীরকে প্রলোভন দেখানো হয়েছিল যে কানাডায় ওয়ার্ক পারমিট খুব সহজ। তাছাড়া অ্যাসাইলাম করলেই অ্যাপ্রুভড হয়ে যায়। দালাল এজেন্সির কথা মত কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করেছিলেন তানভীর। এরপর কানাডার ভিসা আবেদন করেন। ভিসা পাওয়ার পর কানাডা গিয়ে মানবেতন জীবনযাপন করেন তিনি। আর শেষ পরিণতি- মৃত্যুর পর সাহায্য তুলে লাশ দেশে পাঠানো। কিন্তু যে এজেন্সি ১৯ লাখ টাকা নিয়েছিল, সেটির মালিক নিশ্চয় পাজেরো গাড়ি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তাদের টিকিটিও কেউ ধরতে পারে না।
তানভীরের মত হাজারো যুবক আমেরিকা ও কানাডার স্বপ্নে বিভোর। তারা লোভনীয় সব বিজ্ঞাপন দেখে পা বাড়াচ্ছেন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে। কতভাবে সরকার তাদের সতর্ক করছে। বিমানবন্দরে কতজনকে আটকে দেওয়া হচ্ছে। এই আটকানো নিয়েও কত বিতর্ক। কিন্তু কেউ মানছে না। সবার যেন ‘সোনার হরিণ’ চাই।
বাংলাদেশের একশ্রেণির এজেন্সি সোস্যাল মিডিয়ার কল্যাণে কত ভূয়া খবর প্রচার করছে। ডাইভারসিটি ভিসা (ডিভি) লটারিতে বাংলাদেশের আর কোনো সুযোগ না থাকলেও তারা রাতারাতি প্রচার করছে বাংলাদেশে নাকি ডিভি লটারি শুরু হয়েছে। আবার কেউ বলছে- আমেরিকায় নাকি ভিজিট ভিসায় কাজের অনুমতি মিলছে। অথচ কোনোটিই সত্যি নয়। প্রায় দুই লাখ যুবক ও তরুণ স্টুডেন্ট ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে এসেছে গত দুই বছরে। তাদের মধ্যে কেউই কাজ করার অনুমতি পাননি। এসব যুবক তরুণ কাজের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। কিন্তু কোথাও কাজ পাচ্ছেন না। কেউ কাজ পেলেও প্রাপ্ত মজুরি পাচ্ছেন না। সর্বনিম্ন ঘণ্টায় ১৫ ডলারের কাজ করছেন ৫ ডলারে। সপ্তাহ শেষে নিজের থাকা-খাওয়ার খরচ উঠছে না। দেশে স্বজনদের খরচ পাঠাতে পারছেন না। এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন অনেকেই।
বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস সম্প্রতি এক অনুসন্ধানে জানতে পেরেছে- কিছু এজেন্সি যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাওয়ার নিশ্চয়তা দিয়ে পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। এসব বিজ্ঞাপন অত্যন্ত লোভনীয়। তারা আবেদনকারীকে প্রথমে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের পরামর্শ দিচ্ছে। এরপর ভূয়া ব্যাংক ব্যালেন্স ও স্টেটমেন্ট করে দিচ্ছে। এজন্য নিচ্ছে মোটা অংকের টাকা। ‘কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই, -এর মত কিছু ঘটনা পেয়েছে। যেমন ব্যাংকের স্টেটমেন্টে দেখানো হয়েছে অ্যাকাউন্টে ভিসা আবেদনকারীর ৪০ লাখ টাকা আছে। ব্যাংকে ফোন দিলে আবেদনকারীর স্বপক্ষে বলা হচ্ছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহায়তায় ওই গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। এসব ঘটনায় ভিসা আবেদনকারীর ওপর আস্থা রাখতে পারছে না দূতাবাস। তাদের মতে, কিছু ব্যাংকের একশ্রেণির কর্মকর্তা জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত।
আমেরিকায় বৈধভাবে অভিবাসন নেওয়ার নীতিমালা না মেনে কেউ যদি মিথ্যা ও প্রতারণার আশ্রয় নেয়, তবে তাদের ভবিষ্যৎ ভালো হয় না। তারা বৈধতাপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবে। তাই প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে দেশটিতে কেউ রক্ষা পায় না। অভিবাসনে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ধরা পড়লে তাদের ‘আম-ছালা’ দুটোই হারানোর আশঙ্কা রয়েছে।