ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার বদলের পর এখন ব্যাংক ঋণের প্রকৃত চিত্র বেরিয়ে আসছে। দেশের ব্যাংক খাতে গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। তিন মাসেই ব্যাংক ব্যবস্থায় খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। ব্যাংক থেকে বিতরণ করা ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশই বর্তমানে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
বাংলাদেশের মোট ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশই এখন খেলাপি। ভারত, পাকিস্তান ও এমনকি শ্রীলঙ্কার খেলাপি ঋণের হার এত বেশি নয়।
মূলত বিগত সরকারের আমলে বিভিন্ন অনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে নেয়া ঋণগুলো খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হতে শুরু হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে একাধিক ব্যাংক দখল করে একরকম অর্থ লুট করা হয়। এর বাইরে নামে-বেনামে ঋণের নামে অর্থ বের করে নেয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক অনেক ক্ষেত্রে আড়াল করে রেখেছিল বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণ। আবার পটপরিবর্তনের পর অনেকেই পলাতক আছেন। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ ব্যবস্থায় তথ্য কারচুপির মাধ্যমে খেলাপি ঋণ আড়াল করার নীতির অবসান হতে চলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মালিকানা বদল হওয়া ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ শিল্পগোষ্ঠী সহ অনেকের ঋণও খেলাপি হয়ে পড়েছে। ফলে গত জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে সব মিলিয়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর ব্যাংক খাতে নজিরবিহীন জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাংক দখল হয়েছে। বেসিক ব্যাংক, হলমার্ক, বিসমিল্লাহ্, অ্যাননটেক্স, ক্রিসেন্ট, সাদ-মুসার ঋণ জালিয়াতি প্রকাশ হলেও রাজনীতির কারণে ধামাচাপা পড়ে যায়। এখন এসব বেনামি ঋণ খেলাপি হতে শুরু করেছে।
তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর শেষে রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকগুলোর ১ লাখ ২৬ হাজার ১১২ কোটি টাকা খেলাপিতে পরিণত হয়েছে, যা মোট ঋণের ৪০.৩৫ শতাংশ। তিন মাস আগে ছিল ১ লাখ ২ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা বা ৩২.৭৭ শতাংশ। বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর ১ লাখ ৪৯ হাজার ৮০৬ কোটি টাকা বা ১১.৮৮ শতাংশ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। তিন মাস আগে যা ছিল ৯৯ হাজার ৯২১ কোটি টাকা বা ৭.৯৪ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকগুলোর আগের প্রান্তিকের মতোই ৩ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা বা ৪.৯৯ শতাংশ খেলাপি। গত জুনে ৩ হাজার ২২৯ কোটি টাকা বা ৪.৭৪ শতাংশ ছিল খেলাপি। বিশেষায়িত ব্যাংকের ৫ হাজার ৮১৪ কোটি টাকা বা ১৩.২১ শতাংশ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। তিন মাস আগে ছিল ৫ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা বা ১৩.১১ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা বলেন, আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। আবার আগে বিভিন্নভাবে রিট করে যেসব অনাদায়ী ঋণ নিয়মিত দেখানো হচ্ছিলো, তার অনেক এখন খেলাপি হয়েছে। এসব কারণে হয়তো খেলাপি ঋণ বেড়েছে। তবে এখন যেসব তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে, তা সঠিক।
গত ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার আত্মগোপনে চলে যান। বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব পেয়েছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি ব্যাংকগুলোকে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন, আর কোনো তথ্য লুকোচুরি করা যাবে না। নিয়মনীতি আবার আন্তর্জাতিক মানে ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ শ্রেণিকরণ ও প্রভিশনিংয়ের নীতিমালা ছিল আন্তর্জাতিক মানের। তবে ২০১৪ সালের নির্বাচনের ঠিক আগে রাজনৈতিক বিবেচনায় তা শিথিল করে আওয়ামী লীগ সরকার। ২০১৩ সালে নামমাত্র ডাউনপেমেন্টে বিশেষ বিবেচনায় ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ চালু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর ২০১৫ ও ২০১৮ সালে আবারো ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে ঋণ নিয়মিত এবং পুনর্গঠনসহ বিভিন্ন ছাড় দেয়া হয়। সবকিছু ছাপিয়ে মহামারি করোনা শুরুর পর ২০২০ সালে এক টাকা না দিলেও ঋণ নিয়মিত দেখাতে বলা হয়। ২০২১ সালে কিস্তির ১৫ শতাংশ এবং ২০২২ ও ২০২৩ সালে অর্ধেক দিলেই নিয়মিত দেখানো হয়। এতসব সুযোগ দেয়া হলেও খেলাপি ঋণ কমানো যায়নি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা নেয়ার সময় ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা। এরপর বাড়তে বাড়তে ২০১৩ সালের মার্চে খেলাপি ঋণ ঠেকে ৫১ হাজার ২০ কোটি টাকায়। ২০১৯ সালের মার্চে প্রথমবারের মতো খেলাপি ঠেকে ১ লাখ ১০ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকায়। আর গত জুনে প্রান্তিক শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছিল ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। সরকার পতনের পর গত সেপ্টেম্বরে এ তথ্য প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এভাবে গত ১৬ বছরে ১৩ গুণ বেড়ে এখন ৩ লাখ কোটি টাকা ছুঁইছুঁই।
ব্যাংকাররা বলছেন, আন্তর্জাতিক বিধিবহির্ভূতভাবে ২০১৯ সাল থেকে অনাদায়ী ঋণকে নিয়মিত দেখানোর সুযোগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকার ঘনিষ্ঠরা প্রভাব খাটিয়ে বা ব্যাংকগুলো বেশি মুনাফা দেখাতে তথ্য জালিয়াতির মাধ্যমে অনেক অনাদায়ী ঋণ নিয়মিত দেখিয়েছে। এর বাইরে নির্দিষ্ট কিছু আইনজীবীর মাধ্যমে উচ্চ আদালতের কয়েকটি বেঞ্চে রিট করলেই খেলাপি ঋণ নিয়মিত দেখানোর নির্দেশনা দেয়া হচ্ছিলো। এখন এসব সুযোগ বন্ধ হয়েছে।
খেলাপি ঋণ আদায়ে অর্থঋণ আদালত আরও সক্রিয় করা হবে বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। একইসঙ্গে হাইকোর্টে হওয়া রিট মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করার পদক্ষেপ নেয়া হবে।