শনিবার, ৫ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

ক্যাপিটাল হীলে দাঙ্গার একবছরঃ ফিরে দেখা ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারী

লেখকঃ সৈয়দ শাহেদ হক

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৩০ মিলিয়ন মানুষ তথা সারা দুনিয়ার গনতন্ত্রকামী মানুষের কাছে বাক স্বাধীনতা, গনতন্ত্র এবং ভোটাধিকারের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত ক্যাপিটাল হীল, যেখানে বসে অবাদ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত জনগণের সত্যিকারের প্রতিনিধিরা জনগনের আশা আকাঙ্ক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে স্বাধীন ভাবে আইন প্রনয়ন করেন। মার্কিনীদের ঐক্য ও গনতন্ত্রের প্রতীক ক্যাপিটাল হীল আক্রান্ত হওয়ার এক বছর পুর্ন হলো। ক্যাপিটাল হীলের ভাঙা দরজা জানালা মেরামত হলেও গনতন্ত্রকামী মানুষের মন থেকে মুছে যায়নি সেই ক্ষত যা মেরামতের অযোগ্য।অগনতান্ত্রিক ও অশুভ শক্তি দ্বারা ক্যাপিটাল হীল আক্রান্ত হওয়ার এক বছর পুর্তি উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়েছেন। ক্যাপিটাল হীলে, হাউস চেম্বারের ঠিক বাইরে ষ্টেচুয়ারী হলে প্রেসিডেন্ট তার বক্তৃতায় বলেন আমাদের ইতিহাসে এই প্রথম বারের মতো একজন প্রেসিডেন্ট শুধুমাত্র নির্বাচনে হেরে যাননি, তিনি শান্তিপূর্ণ ভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরেও বাঁধা সৃষ্টি করেন”। প্রসিডেন্ট বলেন,  “আমি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, আমি গনতন্ত্রের গলায় কাউকে ছুরি চালাতে দেবোনা। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ট্রাম্পের নাম উল্লেখ না করে বলেন পরাজিত সাবেক এই প্রেসিডেন্টের কাছে আমাদের দেশ এবং গনতন্ত্রের চেয়ে ক্ষমতা বড়”। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৪৫ বছরের গনতন্ত্রের ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায় ছিল ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারী, বুধবার। রীতি অনুযায়ী, কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে এই দিন দেশের পঞ্চাশটি ষ্টেটের পাঠানো ইলেকটোরাল ভোট গননা শেষে আনুষ্ঠানিক ভাবে নব-নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের নাম ঘোষণা করা হয়। দেশের সংবিধান এবং প্রথা অনুযায়ী ক্যাপিটাল হীলে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের সভাপতিত্বে গত বছরের ৬ জানুয়ারী কংগ্রেসের যৌথ সভা শুরু হলেও শেষ হতে পারেনি। নির্বাচনে হেরে যাওয়া রিপাবলিকান দলীয় প্রার্থী বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তার উগ্রপন্থী সমর্থকেরা প্রায় পাঁচ ঘন্টা এই প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করেন। কংগ্রেসের ৬ জানুয়ারীর যৌথ অধিবেশনের আগের দিন থেকেই ক্যাপিটাল হীলের আশেপাশে জড়ো হতে থাকেন ট্রাম্প সমর্থকেরা, ৫ জানুয়ারী রাত ৮ঃ৩৯ মিনিটের সময় ডেমোক্রেট এবং রিপাবলিকান পার্টির কেন্দ্রীয় দফতরে পাইপ বোমা রাখা হলেও তা পরদিন সকালের আগে উদ্ধার করা যায়নি।

৬ জানুয়ারীর ঘটনা প্রবাহঃ সকাল ৭ঃ৪০ মিনিটের সময় ইউএস পার্ক পুলিশের পক্ষ থেকে এক সতর্কবার্তায় বলা হয়, বিপুল সংখ্যক মানুষ ব্যারিকেড ভেঙে ওয়াশিংটন মনোমেন্টে জড়ো হচ্ছেন। ৮ঃ২৭ মিনিটে পরিস্থিতি অনুধাবন করে ডিসি পুলিশের পক্ষ থেকে প্রস্তুতি নেয়া হয়। পুলিশ প্রধান রবার্ট কান্টি বলেন ৮৫০ জন অফিসারের মধ্যে এক পঞ্চমাংশ ক্যাপিটাল হীলে ঐদিন মোতায়েন করা হয়। ৮ঃ৫১ মিনিটে ইউএস সিক্রেট সার্ভিসের পক্ষ থেকে এক সতর্কবার্তায় প্রায় ১০ হাজার মানুষ হোয়াইট হাউসের পাশে জড়ো হওয়ার খবর দেয়া হয়, এদের মধ্যে অনেকেরই গায়ে যুদ্ধের পোশাক এবং সশস্ত্র। এই সমাবেশে প্রসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সকাল ১১টায় ভাষন দেয়ার কথা। ১০ঃ৪১ মিনিটে ডিসি ফায়ার এবং ইমারর্জেন্সী মেডিকেল সার্ভিসের পক্ষ থেকে ডাউনটাউনে জনতার ঢল সামলাতে সাহায্য চাওয়া হয়, বিপুল সংখ্যক মানুষ ছুটে আসছিলেন হোয়াইট হাউসের দিকে, ফলে রাস্তায় গাড়ী চলাচল অচল হয়ে যায়। দুপুর ১২ঃ০০ টায় ট্রাম্প তার বক্তব্য শুরু করেন এবং সমর্থকদের উদ্দেশ্যে বলেন ক্যাপিটাল হীলে গিয়ে শান্তিপূর্ণ ভাবে প্রতিবাদ করার জন্য, অবশ্য পর মুহুর্তেই উস্কানীমূলক বক্তব্যে বলেন “যদি তোমরা ক্যাপিটাল হীলে গিয়ে মরনপন লড়াই না কর তাহলে দেশের অস্তিত্ব হারিয়ে যাবে”। ১২ঃ৪৫ মিনিটে সিনেট চেম্বারে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সের সভাপতিত্বে ইলেক্টোরাল ভোট গননার প্রস্তুতি চলছে এরই মধ্যে সমুদ্রের ঢেউয়ের মত বিপুল সংখ্যক ট্রাম্প সমর্থক চলে আসেন ক্যাপিটাল হীলের খুব কাছাকাছি। ১ঃ০৩ মিনিটে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স টেবিলে হাতুড়ি অর্থাৎ গেভেল দিয়ে শব্দ করে অধিবেশন শুরু করেন। এসময় হোয়াইট হাউসের পাশে ট্রাম্পের চলমান সমাবেশের বক্তব্যের শেষের দিকে তিনি বলেন, “ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স সঠিক সিদ্ধান্ত নিলেই তারা নির্বাচনে জয়ী হবেন”। ১ঃ০৫ মিনিটে হাউস স্পীকার ন্যান্সি পেলোসী গেবল দিয়ে শব্দ করে কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশন শুরুর ঘোষণা দেন। ১ঃ৩০ মিনিটে পুলিশের সব নিরাপত্তা বলয় ভেঙে সশস্ত্র উচ্ছৃঙ্খল বিপুল সংখ্যক ট্রাম্প সমর্থক ক্যাপিটাল হীলের দরজা জানালা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করতে শুরু করে। ১ঃ৪৯ মিনিটে ডিসি পুলিশের পক্ষ থেকে ক্যাপিটাল হীলে রায়ট ঘোষণা করা হয় এবং ডিসি ন্যাশনাল গার্ডের সাহায্য চাওয়া হয়। তবে ন্যাশনাল গার্ড সাহায্যের জন্য আসে ৪ ঘন্টা বিলম্বে। ২ঃ০০ টা’র কিছু সময় পর পর উচ্ছৃঙ্খল ট্রাম্প সমর্থকেরা ক্যাপিটাল হীলের দরজা জানালা অন্যদের জন্য খোলে দেন এবং সাথে সাথে পুরো ক্যাপিটাল হীল দখল করে তারা ভাঙচুর, কাগজপত্র তছনছ এবং হাউস ও সিনেট চেম্বারে ঢুকে ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স এবং হাউস স্পীকার ন্যান্সি পেলোসীর আসনে বসে ছবি তুলেন। ২ঃ২০ মিনিটে সিনেট অধিবেশন স্থগিত করা হয় এবং কংগ্রেসম্যানদেরকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়। এদিকে ট্রাম্প তার বক্তৃতা শেষে ক্যাপিটাল হীলে না গিয়ে হোয়াইট হাউসে বসে তার সমর্থকদের ক্যাপিটাল হীল দখল, ভাঙচুর টেলিভিশনের পর্দায় দেখতে থাকেন, এবং মাইক পেন্সের সমালোচনা করে বেশ কয়েকটি টুইট করেন। ২ঃ৪৫ ক্যাপিটাল পুলিশ ক্যাপিটাল হীলের কর্মচারীদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়। ৩ঃ০০ টা’য় সিনেট চেম্বারে ঢুকে পড়ে উচ্ছৃঙ্খল ট্রাম্প সমর্থকেরা। ৩ঃ৩৬ মিনিটে হোয়াইট হাউস প্রেস সেক্রেটারী কেলিগ ম্যাকেনে এক টুইটে বলেন ট্রাম্প ন্যাশনাল গার্ডকে ক্যাপিটাল হীলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। ৪ঃ০০ টা’র কিছুক্ষন পর নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বক্তব্য দেন। ৫ঃ৪০ মিনিটের সময় প্রায় ৪ ঘন্টা পর ন্যাশনাল গার্ড ডিসি পুলিশের সাহায্যে এগিয়ে আসলে ৬ঃ০০ টা’র কিছু পরে প্রায় ৫ ঘন্টা ক্যাপিটাল হীল উচ্ছৃঙ্খল দাঙাবাজদের হাতে অবরুদ্ধ থাকার পর ন্যাশনাল গার্ডের সহযোগিতায় ডিসি পুলিশ ক্যাপিটাল হীলের নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং অবশেষে ক্যাপিটাল হীলের ভেতর নিরাপদ করে। রাত টায় ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স সিনেট অধিবেশন পুনরায় শুরু করেন। পেন্স বলেন “আজকের দিনটি যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায়…. চলুন আমরা আমাদের কাজ আবার শুরু করি”। রাত টায় হাউস স্পীকার ন্যান্সি পেলোসী হাউসের অধিবেশন শুরু করেন। ১১ঃ৩২ মিনিটে হাউস এবং সিনেট একত্রিত ভাবে অধিবেশনে মিলিত হয়ে ভোট গননা শুরু করেন।

জানুয়ারী ৭, বৃহস্পতিবার, ভোর ৩ঃ৪২ মিনিটে ইলেকটোরাল ভোট গননা শেষে সিনেট সভাপতি ও ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স জো বাইডেনকে আনুষ্ঠানিক ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬’তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা দেন।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১
১৩১৫১৬
১৯২০২১২২২৩২৪২৫
২৬২৭৩০৩১