সম্প্রতি বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির (বাডাস) এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের ২৫ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এ হিসাবে মোট জনগোষ্ঠীর এক-চতুর্থাংশেরও বেশি মানুষ ডায়াবেটিস রোগটি বহন করছেন।
তিনটি ‘ড’-এর মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করা যায়। ডায়েট (পথ্য), ডিসিপ্লিন (নিয়মানুবর্তিতা) ও ড্রাগস (ওষুধ)। ডায়াবেটিসে ডায়েটের কোনো আলাদা বাছ-বিচার নেই। যে কোনো লোকের জন্যই স্বাস্থ্যসম্মত ও উপকারী যে পথ্য, শরীরের ওজন আদর্শ রাখার জন্যও সেই একই পথ্য, এবং ডায়াবেটিসের জন্যও তা-ই। অল্প লবণ, অল্প চিনি, অল্প পশুচর্বি, অল্প ভাজাভুজি; এবং বেশি দুধ, বেশি ডাল ও বেশি আঁশ-দ্রব্য— যেমন আলু, ফলমূল ও শাকসবজি। তবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য ওজন নিয়ন্ত্রণ যেহেতু জরুরি—তাই একটি ক্যালরি-নিয়ন্ত্রিত মেনু অনুসরণ করতে পারলে ভালো হয়। মোটাভাত ও বাদামী রুটিসহ ফলমূল শাকসবজি-জাতীয় আঁশালো খাবারের উপকারিতা এই যে, তা হজম হয় অপেক্ষাকৃত ধীরে। তাই চিনি ইত্যাদি মিহি শর্করা থেকে নাড়িতে-উৎপন্ন গ্লুকোজ যেভাবে দ্রুত রক্তে চলে যায়, আঁশালো খাবার থেকে সেভাবে যায় না। এভাবে রক্তে চিনি নিয়ন্ত্রণ সহজতর হয়।
ডিসিপ্লিনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ সঠিক চিন্তা, ইতিবাচক মনোভাব ও চাপ-নিয়ন্ত্রণ। সেইসাথে দেহচর্চা, মনশ্চর্চা ও প্রফুল্ল ব্যস্ততাসহ বিভিন্ন নির্দোষ সৃজনশীল উপায়ে প্রতিদিন নিজেকে যথাসাধ্য শিথিল ও ভারমুক্ত রাখা। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সুষম আহার ও সুনিদ্রার পাশাপাশি প্রয়োজন পর্যাপ্ত নড়াচড়া ও সক্রিয় জীবনযাত্রা। এক্ষেত্রে ব্যায়াম ও খেলাধুলার গুরুত্ব অপরিসীম।
বিশেষত অ্যারোবিক ব্যায়াম। অ্যারোবিক বা বায়ুজীবী ব্যায়াম হচ্ছে হাঁপিয়ে গিয়ে জোরেজোরে শ্বাস ফেলতে হয় এধরনের যে কোনো সক্রিয়তা। যেমন জোরে হাটা, দৌড়ানো, ব্যাডমিন্টন, ফুটবল, সাঁতার, নৃত্য ইত্যাদি। ডায়াবেটিসে সহজে ও নিয়মিত পালন করা যায় এমন একটা মহা উপকারী ব্যায়ামের উদাহরণ প্রতিদিন আধ ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা করে হাঁটা।
এরপরও ওষুধের প্রয়োজন হলে সেক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক মাত্রায় ট্যাবলেট বা ইনসুলিন ব্যবহার করতে হবে। ইনসুলিন দেহের নিজস্ব কারখানায় তৈরি দেহেরই একটা নিজস্ব দরকারি অন্তঃক্ষরা রস। ওই অর্থে তাকে ওষুধ ঠিক বলা যায় না। অর্থাৎ—মুখের লালা যেমন ওষুধ নয়, বরং শরীরের একটা আপন পদার্থ, ইনসুলিনও তাই। ইনসুলিন নেওয়ার একমাত্র উদ্দেশ্য—শরীরের নিজস্ব ইনসুলিনের ঘাটতিটা সংশোধন করা। বিশেষ দরকার হলে ইনসুলিন তো নিতেই হবে—পরিমিত ইনসুলিন নেওয়ায় তেমন কোন ক্ষতি নেই, উপকার ছাড়া। ইনসুলিনের ক্ষতি সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাগুলো প্রায়শ সঠিক নয়। অতীতে অপরিশোধিত ইনসুলিন থেকে প্রধানত এলার্জি জাতীয় যেসব সমস্যা হতো, আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে আজকাল উন্নত পদ্ধতিতে তৈরি ইনসুলিন থেকে তা দেখা যায় খুবই কদাচিৎ। জ্বর, অসুখ, চাপ ও অনিয়মের ফলে ইনসুলিন নেওয়ার প্রয়োজন বেড়ে যায়। অন্যদিকে ইনসুলিনের প্রয়োজনকে কমিয়ে দেয় ওজন হ্রাস ও নিয়মিত শরীরচর্চা।
চোখ, পা, বৃক্ক ও হৃৎপিণ্ডসহ বিভিন্ন অঙ্গের রক্তনালীর জটিলতাগুলো হচ্ছে ডায়াবেটিসজনিত স্বাস্থ্যের মূল ক্ষতি। এই জটিলতাগুলো সবই কমবেশি প্রতিরোধ্য, শুধু প্রয়োজন সঠিক জীবনপদ্ধতি অনুসরণ। একইসাথে অতিরিক্ত সহায়তা হিসেবে অতীতে চিকিৎসকরা মাঝবয়সী ও বয়স্ক সমস্ত রোগীকে আজীবন অল্পমাত্রায় নিয়মিত অ্যাসপিরিন সেবনের পরামর্শ দিতেন। যেমন দৈনিক ৭৫ মিলিগ্রাম। ইনসুলিনের প্রয়োজন হ্রাস ও ডায়াবেটিসজনিত স্বাস্থ্যের সম্ভাব্য ক্ষতিগুলো আংশিক প্রতিরোধের সাথে সাথে উচ্চ-রক্তচাপ, স্ক্লেরোসিস, করোনারি থ্রম্বোসিস, স্ট্রোক ইত্যাদি বয়স সংশ্লিষ্ট অধিকাংশ শারীরিক সমস্যা মোকাবিলায় নিয়মিত এমন অল্পমাত্রায় অ্যাসপিরিন সেবন ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে, তা সত্যি। তবে অ্যাসপিরিনের সম্ভাব্য পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া বিবেচনায় রেখে বর্তমানে সংশোধিত পরামর্শ হচ্ছে, চিকিৎসকের নির্দেশ ছাড়া সবার জন্য ঢালাওভাবে অ্যাসপিরিন ব্যবহার না করা।
অর্থাৎ সুষম আহার, দেহমনের সুশৃঙ্খল চর্চা এবং প্রয়োজনে ওষুধ, ডায়াবেটিসে এই হচ্ছে নিয়ম। নিয়ম রক্ষা গুরুত্বপূর্ণ, অনিয়ম ক্ষতিকর। অনেকের মতে, ডায়াবেটিস কোনো রোগ নয়, তা একটি নতুন জীবনপদ্ধতি।