উন্নত সমাজ ব্যবস্থা কিংবা বহিঃবিশ্বের সম দৃষ্টিকোণের ভাব ভঙ্গি, আচরণের বৈষম্যতা দূরীকরণ একটি সুস্থ – স্বাভাবিক মানবিক চিন্তা ধারা সমাজের মাঝে বিরাজমান সম্পর্কের মাধ্যমে নারী স্বাধীনতার ভারসাম্য রক্ষা হতে পারে বলে আমি মনে করি।
আমি ভাবতাম এই বৈষম্যতা দৃষ্টিকোণ সবচাইতে বেশি কার্যকর উন্নত বিশ্বের দেশ গুলির মাঝে। তবে ভাববার অবকাশের মেয়াদ যেন পৃথিবী থেকে দ্রুত ফুরিয়ে এসেছে।
যুক্তরাজ্যের একজন স্কুল শিক্ষিকা সাবিনা নেসার ঘটনা আমাদের হতবাক করেছে। যে মেয়েকে ঘর থেকে বেরিয়ে নিশংস ভাবে নরপিচাশ হাতে সম্ভ্রম হারিয়ে বর্বরোচিত হামলার শিকার হয়ে পৃথিবী থেকে চির বিদায় নিতে হয়েছে।
সাবিনা নেসার আর ঘরে ফেরা হলো না ! আজ সাবিনা নয় শুধু ! সাবিনা নেসার মত হাজারো নারী নিশংস হত্যাকাণ্ড শিকার হয়ে মরু বালির মাঝে ঝড় হয়ে কোথায় যেন উড়ে মিলিয়ে যাচ্ছে হাওয়ার তরে!
শুধু নারী জাতির পেছনেই দাবানলের হায়ানোরা লালসার- দৃষ্টি নিয়ে ছুটে আসে যার থেকে বাঁচার উপায় এখনো আমাদের আপামর নারী জাতির বোধগম্যের বাইরে।স্বাধীনতাকামী মানুষের ভিড়ে পরাধীনতার শৃঙ্খল আজ আমাদের পায়ে জড়িয়ে।
আজ শুধু সাবিনা নেসা নয় এর পূর্বে ইংল্যান্ডের মত উন্নত শহরের যেখানে মানব নিরাপত্তা সুরক্ষার প্রাণকেন্দ্র বলা হয়, সেই শহরেই একজন মেট্রোপলিটন পুলিশের কর্মকর্তার হাতে ৩৩ বছর বয়সী সারা এভারার্ড নামে একটি নারীকে নির্যাতনের পরবর্তীতে হত্যা করার ঘটনা আমাকে স্তম্ভিত করেছে। এর আগেও উন্নত বিশ্বে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে। যা লিখে শেষ করার মতো নয়। আজ নারী জাতির নিরাপত্তা কোথায় নিশ্চিত হবে এর কোন ঠিকানা পৃথিবীর কোথাও নেই’।
যুগ যুগ পদচারণা মূখর উন্নত বিশ্বে আইনের মানদন্ড শক্ত অবকাঠামো বিচারব্যবস্থা ভেবেছিলাম পেছনের যুগ আজ পার করে এসেছি। সেই আদিযুগ যেখানে মেয়েরা কন্যা সন্তানের জন্মদানের অপরাধে অভিযুক্ত করে তাদের জীবন্ত কবর দেওয়া হত। যেখানে মেয়েদের পথে-ঘাটে বিক্রি করে দেয়া হতো!
আমাদের অপরাধ ছিল আমরা কেবলই নারী। আমরা কারো মা , আবার আমরাই পৃথিবীর আপামর সন্তানের জননী। আমাদেরকে সর্বাগ্রে বলির শিকার হতে হয় নিশংস ভাবে।আমরা নাকি এই জাতির, এই পৃথিবীর মানব সন্তানের গর্ভধারিনী “মা “?
আমাদের কোথাও ঠাঁই নেই। আমাদের নেই কোথাও নিরাপত্তা। আজ অনেকটা যুগ পেরিয়ে , ভেবেছিলাম সেই যুগ গুলি হয়তোবা অন্ধকারে ডাকা ছিল।যেখানে কোন আলো ছিল না বর্বরতা আর মূর্খতার চাদরে পুরো পৃথিবী ঘেরা ছিল।
তবে আজ পৃথিবী অনেক উন্নত হয়েছে, নির্মল স্বচ্ছ বাতাসের অক্সিজেনের ষোল কলা পূর্ণ হয়েছে, সবুজের সমারোহে পৃথিবী ভরে গেছে। ঊষার আলো মেঘের বুক চিরে বেরিয়ে পৃথিবী আলোকিত করছে আর সেই আলোর সন্ধানে সূর্যের পথে মানুষ পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করছে, উন্নতির দোরগোড়ায় পৌঁছে মানুষ চাঁদে যাচ্ছে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছে । উন্নত বিশ্বের মানুষ প্রযুক্তির উৎকর্ষে দিগন্ত পাড়ি দিয়েছে। শিক্ষার আলো আলোকিত করে পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ।
আমাদের নারী জাতির নিরাপত্তার বলয়ের অবয়ব চাদর অনাবৃত হচ্ছে পথে-ঘাটে সমাজ সংসারে। আমি মনে করি আদি যুগের বর্বরতার সংস্কার হয়তোবা কালের বির্বতনে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে তবে এতটুকু বদলে যায়নি।
রাস্তাঘাটে, কাজে-কর্মে সব জায়গাতেই কিছু সংখ্যক দুশ্চরিত্র পুরুষের লোভনীয় দৃষ্টি থেকে নারীদের রক্ষা নাই এমনকি একজন লেখক হিসেবে হয়তোবা ভেবেছিলাম সোশ্যাল মিডিয়ার এই জগতে প্রাণ খুলে লিখব, প্রাণ খুলে কথা বলব? তবে এখানেও আমাদের মাথা উঁচু নয়?
একজন পুরুষ লেখক যেভাবে মনের জানালা খুলে সবকিছু লিখতে পারে আমাদের সেখানে বাধা এসে যায়! আমাদের আঙ্গুল উঁচু করে দেখিয়ে দেয় আমরা একজন নারী আমাদের সব জায়গায় যেতে মানা। আমাদের সীমানার গণ্ডি বেঁধে দেওয়া। এখনেও আমরা মাথা উঁচু করে কথা বলতে পারিনা লিখতে পারিনা, নিজের ইচ্ছামত ছবি পোস্ট করতে পারি না, আমাদের ইনবক্সে লোলুপ দৃষ্টির কালো ছায়ায় ভিড় জমে যায় । অনবরত কটাক্ষ আর বিরক্তিকর শব্দে আমাদের মানদণ্ডের বিভেদ বলে দেয় আমরা একজন নারী। আমরা স্বাধীনতার অবয়বে এক পরাধীনতার শিকলে বাধা।
আমি জানিনা আর কত যুগ পরে এমন কোন সমাজ এমন কোন পৃথিবীর মাঝে নারীরা বেঁচে থাকবে, যেখানে আমরা মাথা উঁচু করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে অনেকটা পথ চলতে পারব। ভয় উৎকণ্ঠা নিরাপত্তাহীনতার তরঙ্গে আমাদের নিশ্বাস থেমে যাবে না। আমরা নিরাপদে একা একা ঘরে ফিরে যেতে পারবো।
এমন কোন একদিন আসবে এই পৃথিবীতে ? যেখানে স্বপ্নলোকের দিবানিশি প্রভাতে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে এক স্বর্ণালী পৃথিবীর মাঝে বেঁচে থাকব।
যেখানে আমরা সমাজে প্রকৃত মায়ের স্বীকৃতি পাবো আজ মা হয়ে ও পথে-ঘাটে আত্মচিৎকার আর বীভৎসতায় নিজের ওমরন লাশের মিছিল থেকে বেরিয়ে আসবো।
আজ সাবিনা নেসা মত হাজারো অবলা মেয়েদের চলে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহ অবলোকন করে পরাধীনতার চাদরে মাথা ডেকে মুখ লুকিয়ে তাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া ছাড়া আমার যে আর কিছুই করার নেই।
লেখকঃ মরিয়ম চৌধুরী (যুক্তরাজ্য)