নিউইয়র্কে হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের উদ্বোধনকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম বলেছেন, প্রবাসের প্রজন্ম যারা বাংলা পড়তে পারে না, তাদের কাছেও বাঙালির কালজয়ী সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের লেখা পৌঁছে দিতে আমার কিছু ছাত্র-ছাত্রী অনুবাদকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। বছর তিনেকের মধ্যেই ইংরেজিতে বেশ কটি বই বাজারে আসবে।
এভাবেই হুমায়ূন আমরা বিশ্ব বাঙালির কাছে এবং ভিনদেশী পাঠকের হৃদয়ে স্থায়ী করার চেষ্টা চালাচ্ছি। হুমায়ূনের বিখ্যাত গল্প, উপন্যাস, নাটকের বিশ্বায়নের মধ্যদিয়ে প্রকারান্তরে বাংলা সাহিত্যকেই মহিমান্বিত করার বিশ্বাস থেকে আমরা কাজ করছি।
সৈয়দ মঞ্জুরুল বলেন, হুমায়ূন আহমেদ গীতিকারও ছিলেন। এই নিউইয়র্কে বসে জীবনের শেষ দিনগুলোতে তিনি চিত্রাঙ্কনও করেছেন। তার সাথে আমার পরিচয় ১৯৭৪ সালে। আমি শিক্ষক হিসেবে যোগদানের এক বছর আগে তিনি যোগ দিয়েছিলেন। তার সাথে কথা হতো বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে। তিনি বলতেন যে, তিনি বিজ্ঞানের সত্যের সন্ধানে আছেন। আমি বলেছিলাম যে, বিজ্ঞানের একটি কল্পনাও রয়েছে। তিনি বলেন সেই কল্পনারও সন্ধানে আছি।
তার মিছির আলী চরিত্রটা বিজ্ঞানের সত্য এবং কল্পনা দুটোই ধারণ করে। সাহিত্যে কল্পনাকে তো তিনি অবশ্যই ধারণ করেছিলেন। তবে সাহিত্যে কিছু সত্য আছে। সাহিত্য মানুষকে সৌন্দর্য শেখায়। সত্য-মিথ্যার প্রভেদ করতে শেখায়। সাহিত্য মনের জানালাগুলো খুলে দেয়। সেই জানালা দিয়ে সমস্ত পৃথিবীটা মানুষ দেখতে পায়। এই বিষয়গুলোর খুব গুরুত্ব দিতেন হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর সাহিত্যে তিনি মনকে জাগাবার চেষ্টা করতেন।
সৈয়দ মঞ্জুরুল উল্লেখ করেন, তিনটি বিষয়ে তার ভীষণ অধিকার ছিল। যে তিনটি বিষয়ের সমন্বয়ে তিনি সাহিত্য রচনা করেছেন তা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে। প্রথমত: জীবনের সত্যের কাছে একনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি কল্পনা করেছেন, তবে দেখবেন যতগুলো উপন্যাস লিখেছেন, সবগুলোতে মধ্যবিত্ত জীবনের প্রতিফলন ছিল। কোথাও কৃত্রিমতার প্রকাশ ঘটেনি। প্রকৃত সত্যটিরই প্রকাশ ঘটিয়েছেন।
দ্বিতীয় ছিল ভাষা। তিনি রসায়নের অধ্যাপক ছিলেন, সেটি যেমন সত্য, একইভাবে মানুষের মনের রসায়নও জানতেন। ভাষার রসায়নটাও তিনি জানতেন। দুটোর সমন্বয়ে যে সাহিত্যের সৃষ্টি করেছেন তা অকাতরে মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছেন।
তৃতীয়ত: ছিল তার সাধনা। প্রতিদিনই তিনি লিখেছেন। এত লিখতেন যে, তার কিছু সমালোচক বলতেন, এত উপন্যাস লিখে লাভ কি। জবাব দিতেন যে, আমার উপন্যাস পড়ে যদি মানুষ আনন্দ পায় তাহলে কেন লিখবো না। একটি গান কি আপনি একবার শোনেন? অনেকবারইতো শোনেন। একই উপন্যাস পড়ে যদি আনন্দ পান, দ্বিতীয়টিও যদি আনন্দ দেয়, তাহলে তৃতীয়টি নয় কেন?
হুমায়ূন আহমেদ স্মরণে দিনব্যাপী সম্মেলন আয়োজনের জন্যে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানিয়ে মেহের আফরোজ শাওন বলেন, নিউইয়র্কের সাথে আমার এবং আমাদের দুই পুত্রের অম্ল-মধুর সম্পর্ক। এই শহর আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যখন দুই শিশু পুত্র নিনিত আহমেদ ও নিশাদ আহমেদ সহ হুমায়ূন আহমেদকে চিকিৎসার-যুদ্ধ করতে নিউইয়র্কে আসি তখন অনেক কিছু পেয়েছি এই নিউইয়র্ক বাসীর কাছ থেকে। আবার অনেক কিছু হারিয়েছিও। হুমায়ূন আহমেদকে যেমন হারিয়েছি। অনেক বন্ধুকে হারিয়েছি।
স্মৃতিচারণকালে কন্ঠযোদ্ধা রথীন্দ্রনাথ রায় বলেন, আমার পরম সৌভাগ্য যে ঢাকা কলেজে একইসাথে পড়তাম। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি এমন একজন সৃষ্টিশীল মানুষ ছিলেন যে, কোন সেক্টর খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে তাঁর সরব উপস্থিতি ছিল না। সাহিত্য, গল্প, সিনেমা, নাটক সর্বত্র। ছোট ছোট জায়গায় কোন বিষয়টি কীভাবে উপস্থাপন কিংবা সংযোজন করতে হবে, সে ক্ষেত্রে তার মুন্সিয়ানা ছিল প্রবল।
সম্মেলনে হুমায়ূনের সাহিত্য কর্ম নিয়ে আলোকপাতের পাশাপাশি বাঙালি সাহিত্যকে সর্বজনীনতার ক্ষেত্রে হুমায়ূনের ভূমিকা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে বলে মতামত প্রকাশ করে আরও বক্তব্য দেন কন্ঠযোদ্ধা শহীদ হাসান, অন্যপ্রকাশের মাজহারুল ইসলাম, ফোবানার সাবেক চেয়ারম্যান জাকারিয়া চৌধুরী, মুক্তচিন্তার লেখক ফকির ইলিয়াস, এটিএন বাংলার চীফ নিউজ এডিটর জয় ই মামুন, লেখক ফরহাদ হোসেন, ইশতিয়াক রুপু, নাসির খান পল, রওশন হাসান, ইব্রাহিম চৌধুরী খোকন, মিশুক সেলিম, আহসান হাবিব প্রমুখ।