পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য সংসদ সদস্য নির্বাচন করতে আজ শুক্রবার (১৯ এপ্রিল) থেকে ভোট প্রয়োগ শুরু করবেন ভারতের নাগরিকরা। এই নির্বাচনে দেশটির বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার জন্য লড়ছেন। অন্যদিকে বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের বিপরীতে লড়াই করছে ‘ইন্ডিয়া’ জোট। কংগ্রেসসহ দুই ডজনেরও বেশি বিরোধী দল এই জোটে রয়েছে।
এদিকে, এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। এরই মধ্যে বোমাবাজি, গুলি চালানাের অভিযোগ উঠেছে। এছাড়াও বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা, মদ ও মাদক বাজেয়াপ্ত করেছে দেশটির নির্বাচন কমিশন। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে সহিংসতার আশঙ্কা বেশি দেখা দিয়েছে। গোটা দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হবে পশ্চিমবঙ্গে। অন্যদিকে, বিভিন্ন জনমত জরিপে মোদীর ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) এবং তার জোটকে এগিয়ে রাখা হয়েছে। যদিও বিরোধীরা অভিযোগ করছে, তারা পক্ষপাতিত্বের শিকার হচ্ছেন, কারণ কেন্দ্রীয় এজেন্সিগুলি অনেক বিরোধী নেতাদের বাড়িতেই তল্লাশি অভিযান চালাচ্ছে। কংগ্রেস বলছে ছয় সপ্তাহ ধরে আয়কর বিভাগ তাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে রেখেছে। যার ফলে নির্বাচনী প্রচারণার খরচ চালাতে তাদের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।আবার দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের মতো বেশ কয়েকজন বিরোধী নেতাকে দুর্নীতির দায়ে গ্রেফতার করা হয়েছে। যদিও সব দুর্নীতির অভিযোগ তারা সকলেই অস্বীকার করছেন।
এদিকে, বিরোধীরা নির্বাচন কমিশনকে হস্তক্ষেপ করার বিষয়ে আবেদন করেছিল। সে কারণে নির্বাচন কমিশনও আবার তাদের স্বাতন্ত্র্য নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। যদিও নির্বাচন কমিশন বলছে, তারা সব দল এবং প্রার্থীদের সমান নজরে দেখছে, পক্ষপাতিত্ব করছে না তারা।
ভারতের নির্বাচনের পরিসংখ্যান:
প্রায় ১৪০ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারত বিশ্বের সবথেকে জনবহুল দেশ। এরকম একটা দেশের নির্বাচন সংক্রান্ত সংখ্যাগুলোর দিকে তাকালে মাথা ঘুরে যেতেই পারে। লোকসভার ৫৪৩ জন সদস্যকে নির্বাচন করতে ছয় সপ্তাহ ধরে সাত দফায় ভোট নেওয়া হবে।
নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হবে ৪ জুন। এই নির্বাচনে ভোটারের সংখ্যা ৯৬ কোটি ৯০ লক্ষ। এবারের ভোটারদের মধ্যে ৪৯ কোটি ৭০ লক্ষ পুরুষ এবং ৪৭ কোটি ১০ লক্ষ নারী।
প্রথমবার ভোট দেবেন, অর্থাৎ যাদের বয়স ১৮-১৯ বছর, এমন ভোটার এক কোটি ৮০ লক্ষ। প্রবীণ ভোটার, যাদের বয়স ৮৫ থেকে ৯৯ বছর, এরকম ৮২ লাখ মানুষের নাম আছে ভোটার তালিকায়।
দেশটির সব জায়গায় পৌঁছবেন ভোটকর্মীরা:
নিরাপত্তা আর ভোটের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার কারণেই সাত দফায় ভোট করানো হচ্ছে।
বয়স্ক আর শারীরিক প্রতিবন্ধকতা আছে যাদের, তাদের বাড়িতে গিয়েও ভোট নেওয়ার ব্যবস্থা করেছে নির্বাচন কমিশন।
এ বিষয়ে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব কুমার বলেছেন, “ভারতের প্রতিটি কোনায় গণতন্ত্রকে পৌঁছিয়ে দেওয়ার জন্য” সারা দেশে ১৫ লাখ ভোট কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে।
রাজীব কুমার আরও বলেছেন, একজন ভোটার জঙ্গলে বাস করুন অথবা তুষারাবৃত পাহাড়ে, আমাদের কর্মীরা বাড়তি পরিশ্রম করে হলেও প্রত্যেক ভোটারের কাছে পৌঁছবেন। আমরা ঘোড়া আর হাতি পিঠে চেপেও যেমন যাব, তেমনই হেলিকপ্টারেও যাব। আমরা সব জায়গায় পৌঁছব।
বেশিরভাগ ভোটগ্রহণ কেন্দ্রই স্কুল, কলেজ বা কমিনিউটি সেন্টারে হলেও বেশ কিছু অদ্ভুত জায়গাও বাছা হয়েছে বুথ তৈরি করার জন্য – যার মধ্যে রয়েছে জাহাজের কন্টেইনার, পাহাড়ের চূড়া বা জঙ্গলের মধ্যেও বুথ হচ্ছে।
দেশটির নির্বাচনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেসব রাজ্য:
রাজনৈতিকভাবে দেশটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য হলো উত্তরপ্রদেশ। রাজ্যটিতে ভোটার রয়েছেন প্রায় ২৪ কোটি। এটিই ভারতের সবথেকে জনবহুল রাজ্য আর এখান থেকেই সংসদে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সদস্য নির্বাচিত হন।
বিশ্লেষকরা বলেন, দিল্লি যাওয়ার পথটা উত্তর প্রদেশ হয়েই যায়। এই রাজ্যে যে দল ভালো ফল করে, সাধারণত ভারত শাসন করে থাকে তারাই। এই রাজ্য থেকে ভারতের আটজন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন।
নরেন্দ্র মোদী ২০১৪ সালে যখন প্রথম ক্ষমতায় আসেন, সেবছর বিজেপি উত্তরপ্রদেশের ৮০টির মধ্যে ৭১টি আসনে জিতেছিল। পরের বার, ২০১৯ সালে অবশ্য বিজেপির জেতা আসনের সংখ্যাটা কমে ৬২ হয়েছিল। মোদী ২০১৯ সালে দেশটির প্রাচীন শহর বারাণসী আসন থেকে জিতেছিলেন, এবারও তিনি ওই আসন থেকেই ভোটে লড়ছেন।
উত্তর প্রদেশ থেকে যেমন সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন, অন্যদিকে রয়েছে সিকিম, নাগাল্যাণ্ড, মিজোরাম আর আন্দামান, লাক্ষাদ্বীপ এবং লাদাখের মতো কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলগুলি, যার প্রতিটি থেকে মাত্র একজন করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
অন্য যেসব রাজ্য এবারের নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, তার মধ্যে আছে ৪২টি আসনের পশ্চিমবঙ্গ, ৪৮টি আসনের মহারাষ্ট্র, ৪০ আসনের বিহার এবং ৩৯টি আসনের তামিলনাডু রয়েছে।
এদিকে, গোটা দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হবে পশ্চিমবঙ্গে। প্রথম দফায় উত্তরবঙ্গের তিন আসনে শুক্রবার ভোট নেওয়া হবে। একের পর এক নির্বাচনে সহিংসতা ও মৃত্যুর অভিজ্ঞতাকে সঙ্গে নিয়ে শুরু হচ্ছে দেশের সরকার গঠনের নির্বাচন।
পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনের পরিসংখ্যান:
ভোট শুরুর ঠিক আগে পশ্চিমবঙ্গ সম্পর্কে নির্বাচন কমিশন যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে, তা যথেষ্ট উদ্বেগের।
গত বছর পঞ্চায়েত নির্বাচনেই রাজনৈতিক হানাহানিতে কমবেশি ৫০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পর জেলায় জেলায় সহিংসতার ছবি দেখা গিয়েছিল। এর মাত্রা আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠে বোমা, গুলির ব্যবহারে। পশ্চিমবঙ্গে প্রায় নিয়মিত বোমাবাজি, বোমা উদ্ধার বা গুলিচালনার মতো ঘটনা ঘটে।
নির্বাচন ঘোষণার পর থেকেই গোটা দেশের পুলিশ, প্রশাসন পরিচালনার ভার জাতীয় নির্বাচন কমিশনের হাতে। পশ্চিমবঙ্গে একগুচ্ছ বদলির পাশাপাশি তল্লাশি অভিযান জোরদার করা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের হিসেব অনুযায়ী, গত এক মাসে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মোট এক হাজার চারটি বোমা উদ্ধার করা হয়েছে। বিস্ফোরক পদার্থ পাওয়া গিয়েছে ৪১ কেজির বেশি। এ ছাড়া ৩৭৮টি অস্ত্র, ৫৪৩টি কার্তুজও উদ্ধার করা হয়েছে।
এছাড়া নির্বাচন এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যটিতে উত্তেজনার পারদ চড়ছে। আশঙ্কা বাড়ছে, কত বোমা, বিস্ফোরক বা আগ্নেয়াস্ত্র এখনও দুষ্কৃতীদের নাগালে রয়ে গেল! আশঙ্কা সত্যি করে বোমাবাজি, গুলিচালনার মতো ঘটনা ঘটেছে গত ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে।
বুধবার বিকেলে রামনবমী উৎসব উদযাপন সমিতি মুর্শিদাবাদের শক্তিপুর বাজারে মিছিল করে। অভিযোগ, সেই মিছিলে ইট ছোড়া হয়। পাল্টা মিছিল থেকেও ইট ছোড়া হলে সংঘর্ষের পরিস্থিতি তৈরি হয়। এরই মধ্যে বোমা পড়ে বলে অভিযোগ। বোমাবাজির মধ্যেই আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় কয়েকটি দোকানে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটায় পুলিশ। লাঠিচার্জ করা হয়। আহত হন বেশ কয়েকজন।
এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের কিছু কিছু এলাকা ও লোকসভা কেন্দ্র খুবই উত্তেজনাপ্রবণ ও স্পর্শকাতর। এর মধ্যে অন্যতম উত্তর ২৪ পরগনার ভাটপাড়া কেন্দ্র। তৃণমূল থেকে বিজেপিতে গিয়ে ফের তৃণমূলের টিকিটে লড়ছেন অর্জুন সিং। তার বিরুদ্ধে রাজ্যের শাসকদলের প্রার্থী মন্ত্রী পার্থ ভৌমিক। ভাটপাড়া পৌরসভার ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে এক তৃণমূল সমর্থক গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।
বিরোধীদের অভিযোগ, রাজ্যের সর্বত্র শাসক দলের মদতে বোমা, গুলির কারবার চলছে। এই অভিযোগের সত্যতা প্রমাণে তারা সামনে রাখছে পূর্ব মেদিনীপুরের এগরা, ভূপতিনগরে বিস্ফোরণকে। দুটি ক্ষেত্রেই অনেকে হতাহত হয়েছেন, এর মধ্যে তৃণমূলের স্থানীয় নেতাকর্মীরাও আছেন। তাই শাসক দলের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল উঠেছে।
দেশটির বিভাজনের রাজনীতি:
ধর্মীয় বিভাজন ভারতে দীর্ঘদিন ধরেই ছিল, কিন্তু সরকারের সমালোচকরা বলেন যে ওই বিভাজন রেখাটা বিজেপির গত এক দশকের শাসন কালে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তাদের কথায়, ভারতের ধর্ম নিরপেক্ষতা ক্রমশই প্রশ্নের মুখে পড়ছে এবং দেশটা একটা হিন্দু রাষ্ট্র হওয়ার দিকে এগোচ্ছে। দেশের সবথেকে বড় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় – প্রায় ২০ কোটি মুসলমান, ক্রমশ কোনঠাসা হচ্ছেন।
সরকার অবশ্য এই ব্যাখ্যা অস্বীকার করেছে আর বলেছে তারা সবাইকে নিয়েই চলে। যদিও গত লোকসভায় বিজেপির একজনও মুসলমান সংসদ সদস্য ছিলেন না।
এদিকে এমন একটা সময় এই নির্বাচন হতে চলেছে, যখন বিরোধী পক্ষ, সমাজকর্মী আর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলি অভিযোগ করছে যে ভারতের গণতন্ত্র এখন হুমকির মুখে। রাহুল গান্ধী অভিযোগ করেছেন যে সরকার বিরোধী দলের নেতাদের টার্গেট করেছে, তাদের ওপরে নজরদারি চালাচ্ছে আর সংসদ, বিচার ব্যবস্থা এবং সংবাদমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে কাজেও নানা বাধা সৃষ্টি করছে। সরকার অবশ্য এই সব অভিযোগই অস্বীকার করে।
এখন দেখার বিষয় ভারতের নাগরিকরা আগামী পাঁচ বছরের জন্য দেশটির ক্ষমতায় কাদের স্থান দেয় এবং দেশটির ভবিষ্যৎ কোনদিকে অগ্রসর হয়।