রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বহুল আলোচিত ‘সাদিক অ্যাগ্রো ফার্ম’ থেকে ১৫ লাখ টাকার ছাগল কিনে ভাইরাল হওয়া ১৯ বছর বয়সী তরুণ মুশফিকুর রহমান ইফাতের বাবার সম্পদ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা।সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সর্বত্র আলোচনার কেন্দ্রে ১৫ লাখ টাকার ছাগল ও ছাগল ক্রেতার বাবা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা ড. মতিউর রহমান। যদিও মতিউর ইফাতকে তার ছেলে হিসেবে অস্বীকার করেছেন। তিনি বর্তমানে কাস্টমস এক্সাইজ ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট।
অভিযোগ রয়েছে, সরকারি এই কর্মকর্তা দুর্নীতির মাধ্যমে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। ইতোমধ্যেই বেরিয়ে এসেছে তার বেশুমার সম্পদের তথ্য। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা মতিউরের জ্ঞাত এবং জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের তথ্য জানতে মাঠে নেমেছে। আর প্রাক অনুসন্ধানে তারা পেয়েছে বিস্ময়কর সব তথ্য।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবরে জানা যায়, নরসিংদী, ময়মনসিংহের ত্রিশাল ছাড়াও গাজীপুরের পূবাইলে রিসোর্ট, শুটিংস্পট, বাংলো বাড়ি, জমিসহ নামে-বেনামে রয়েছে অঢেল সম্পদ। বরিশালেও রয়েছে তার সম্পদ।
জানা গেছে, প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজকে বিপুল অর্থ খরচ করে বানিয়েছেন উপজেলা চেয়ারম্যান। দ্বিতীয় স্ত্রী ব্যাংক কর্মকর্তা। তাদের নামেও রয়েছে সম্পদের পাহাড়। এর মধ্য প্রকাশ হয়েছে, কোরবানির পশু কিনে ভাইরাল যুবকটি মতিউরের দ্বিতীয় স্ত্রীর আগের ঘরের সন্তান। ব্যাংকার এই নারী মতিউরের টাকা পয়সার লেনদেন করেন।
আরও জানা যায়, শুধু দেশে নয় বিদেশে বাড়ি রয়েছে তার। তার ছেলের রয়েছে বিশ্বের নামিদামী ব্র্যান্ডের গাড়ির কালেকশন। এসব বিষয়ে ইতোমধ্যেই খোঁজ খবর নিতে শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
তবে মতিউর রহমানের দাবি, তার সব সম্পদ বৈধ এবং পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ থেকে আসা মুনাফার মাধ্যমে অর্জিত। তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, তার দুই সন্তান অর্ণব ও ইপসিতার নামে পুঁজিবাজার এবং এর বাইরের প্রায় ডজনখানেক কোম্পানির অংশীদারত্বের নথিপত্র এসেছে। এসব নথিপত্র বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গাজীপুরের গ্লোবাল সু ও গ্লোবাল ম্যাক্স প্যাকেজিং কোম্পানিতে তার দুই সন্তান অর্ণব ও ইপসিতার মালিকানা রয়েছে। আর পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বেশ কয়েকটি কোম্পানিতে এই দুই প্রতিষ্ঠানের নামে কৌশলে প্লেসমেন্ট শেয়ার নেন মতিউর রহমান। আর গ্লোবাল ম্যাক্সের মালিকানা রয়েছে পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানি এসকে ট্রিমস ইন্ডাস্ট্রিজে। ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠান শাহজালাল ইক্যুইটিতেও মালিকানা রয়েছে তার। শুধু ইক্যুইটি ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি নয়, অ্যাসোসিয়েট অক্সিজেন নামে পুঁজিবাজারের আরেক কোম্পানিতে ২৭ লাখ ৪৫ হাজার ৫০০ শেয়ার রয়েছে।
জানা গেছে, মতিউর রহমান বসুন্ধরার আবাসিক এলাকায় থাকেন। তার পারিবারিক মালিকানাধীন বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের হেড অফিসও ওই এলাকায়। এ ছাড়া মতিউর রহমানের ছেলে অর্ণবের নামে অর্ণব ট্রেডিং নামেও একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ ছাড়া তার মেয়ের ল্যাম্বারগিনি নামে বিলাসবহুল গাড়ির ব্যবহারের ছবিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। যার দাম প্রায় ৪ লাখ কানাডিয়ান ডলার বা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪ কোটি টাকা।
এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে ড. মতিউর রহমানের অফিসে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। পরবর্তীকালে তার মোবাইলে কল দিলেও তিনি কোনো সাড়া দেননি।
গত বুধবার তিনি এক গণমাধ্যমের কাছে দাবি করেন, মুশফিকুর রহমান ইফাত তার ছেলে নয়। তার এক ছেলে তৌফিকুর রহমান অর্ণব ও মেয়ে ফারজানা রহমান ইপসিতা। এর বাইরে তার কোনো সন্তান নেই।
আলোচিত ইফাত কাস্টমস কর্মকর্তা মতিউর রহমানের ছেলে বলে জানিয়েছেন তার আত্মীয় ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য নিজাম হাজারী। গণমাধ্যমে তিনি বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুশফিকুর রহমান ইফাতের ছবি তিনি দেখেছেন। এটা তার মামাতো বোনের ছেলে। আর তার বাবা এনবিআর সদস্য ড. মতিউর রহমান। আর মতিউর রহমান তার বোনকে সামাজিক মর্যাদা দেন এবং বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত হয়েছেন।
মতিউর রহমান হয়তো রাগ করে ছেলেকে অস্বীকার করছেন বলে ধারণা এ সংসদ সদস্যের।
জানা গেছ, শুধু রাজধানী ঢাকা বা গাজীপুরে নয়, মতিউর রহমান অঢেল সম্পত্তি কিনেছেন শ্বশুরবাড়ি নরসিংদীতেও। তার স্ত্রী লায়লা কানিজ আগে সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ছিলেন। এখন চাকরি ছেড়ে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন। আর প্রভাবশালী স্বামীর প্রভাবে ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এর আগে নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও দুর্যোগবিষয়ক সম্পাদকের পদ বাগিয়ে নেন।
শিক্ষক থেকে রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া লায়লার নামে পার্ক-রিসোর্ট থেকে শুরু করে রয়েছে বাণিজ্যিক এলাকায় কোটি কোটি টাকার জমি-প্লট। এছাড়া রাজধানীর বসুন্ধরার ডি ব্লকের ৭/এ রোডের ৩৮৪ নম্বর বাড়িতে স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে রয়েছে একটি ফ্ল্যাট। বসুন্ধরার ডি ব্লকে রয়েছে ৫ কাঠায় ৭ তলা বাড়ি, যার দোতলায় মতিউর রহমান পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। এ ছাড়াও গাজীপুর সদর, খিলগাঁও মৌজায় এসএ ১৭১ আরএস ২৮০ দাগে ১০ দশমিক ৫০ শতক; এসএ ১৭২ আরএস ২০১ দাগে ৩ দশমিক ৯০ শতক; এসএ ১৬৩ আরএস ২৭৫ দাগে ৭ দশমিক ৫০ শতক, এসএ ১৬৩ আরএস ২৭৬ দাগে ৬ শতক; এসএ ১৭০ আরএস ২৭৯ দাগে ৬ শতক; এসএ ১৬৩ আরএস ২৭৬ দাগে ৭ শতক; এসএ ১৭০ আরএস ২৭৯ দাগে ৬ শতক; গাজীপুর থানার খিলগাঁও মৌজায় ৩৫৫৭ জোতে ৪৮ দশমিক ১৬ শতাংশ, জোত ৩৪৫০-এ ১৪ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং জোত ৩৬৫২-এ ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্ণব, স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে শূন্য দশমিক ৪৫১৬২৫ একর জমি রয়েছে। গ্লোবাল সুজ লিমিটেড কোম্পানির নামে জোত ১২৫-এ ৩৪৩৪৫ শতক, জোত ৭০-এ ২৮০০ শতক, জোত ৯০-এ শূন্য দশমিক ০৩৩০ শতক জমি রয়েছে। এই ৭টি খতিয়ান মিলিয়ে মোট জমির পরিমাণ ৬০ শতাংশ। এ ছাড়াও সাভার থানার বিলামালিয়া মৌজায় খতিয়ান ১৩০৩৫ দাগ ১৭৬৩ ও ১৭৬২-এ ১২ দশমিক ৫৮ শতক জমি রয়েছে। লায়লা কানিজের নামে সাভার থানার বিলামালিয়া মৌজায় খতিয়ান ১৩৬৯৬-এ ১৪ দশমিক ০৩ শতাংশ জমি রয়েছে।
মতিউর রহমানের প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকির নামে নরসিংদীর রায়পুরার মরজালে শত বিঘা জমির ওপরে গড়ে তোলা হয়েছে লাকি পার্ক নামে আলিসান রিসোর্ট, যার বর্তমান নাম ওয়ান্ডার পার্ক। এসব পার্ক করতে গিয়ে জায়গা দখলেরও অভিযোগ রয়েছে।