গত ৫ নভেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই নির্বাচনে কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ পরিষদে ৪ জন মুসলিম প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন। যারা বিশ্বব্যাপী মুসলিম নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর হিসেবে পরিচিত। বিশেষ করে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি বাহিনীর বর্বর গণহত্যার বিরুদ্ধে কথা বলে তারা নানা সময়ে আলোচিত হয়েছেন। এ চার মুসলিম প্রতিনিধি সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণী তুলে ধরা হলো।
রাশিদা তালিব : ডেমোক্রেটিক পার্টির আলোচিত মুসলিম নারী সদস্য রাশিদা তালিব মার্কিন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। তিনি ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত হিসেবে মার্কিন কংগ্রেসের একমাত্র সদস্য। ডিয়ারবর্নের বৃহৎ আরব-আমেরিকান সম্প্রদায়ের সমর্থনে মিশিগানের প্রতিনিধি হিসেবে চতুর্থ মেয়াদে জয়ী হয়েছেন। তিনি রিপাবলিকান জেমস হুপারকে বিপুল ভোটে পরাজিত করেছেন। এই ফিলিস্তিনি মুসলিম নারী এমন এক সময়ে মার্কিন কংগ্রেসে পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন, যখন গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন পুরোদমে চলছে।
ডেমোক্র্যাট দলের সদস্য হলেও রাশিদা তালিব সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দলের প্রার্থী কমলা হ্যারিসকে সমর্থন দেননি। রাশিদা তালিব ইসরায়েলে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া সামরিক সাহায্যের তীব্র বিরোধিতাকারীদের একজন। এ ছাড়া তিনি গাজা ও পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি জনগণের পক্ষে জোরালো কণ্ঠস্বর। গাজায় গত এক বছর ধরে চলা ইসরায়েলি আগ্রাসনে বাইডেন প্রশাসনের নৈতিক অবস্থানের কঠোর সমালোচক রাশিদা তালিব। নির্বাচনের তিন দিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মিশিগানের ডিয়ারবর্ন শহরে ট্রাম্পের প্রচারণা চালানো নিয়েও সমালোচনা করেছেন তিনি। তিনি লিখেছেন, ‘ভুলে গেলে চলবে না, ট্রাম্প একজন ইসলামোফোব ও মিথ্যাবাদী। আর ইসরায়েলের চালানো গণহত্যায় বাইডেন প্রশাসনের নীরব সমর্থন আমাদের এখানে এনেছে। এখন সময় এসেছে সবাই জেগে ওঠার। নিজেদের ক্ষমতাকে খাটো করে দেখবেন না। সব বিজ্ঞাপন, প্রজ্ঞাপন, প্রচারণার চেয়ে বেশি শক্তি ধারণ করে জনগণ। আমাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়তে হবে। অর্থলোভীদের কাছ থেকে দেশকে উদ্ধার করতে হবে।’
সম্প্রতি মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ কংগ্রেসে তার বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব পাস হয়েছে। গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলা এবং তাতে মার্কিন সরকারের সমর্থনের সমালোচনা করায় এই নিন্দা প্রস্তাব আনা হয়। তবে ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত এই নারী আইনপ্রণেতা বলেছেন, তাকে চুপ করানো যাবে না। নিন্দা প্রস্তাবে বলা হয়েছে, বিরোধী শিবির রিপাবলিকানদের আনা প্রস্তাবটি ২৩৪-১৮৮ ভোটে গৃহীত হয়েছে। এমনকি ক্ষমতাসীন রাশিদা তালিবের ডেমোক্র্যাট দলীয় কিছু সদস্যও প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর থেকে গাজায় অব্যাহত ইসরায়েলি আক্রমণের বিষয়ে রাশিদা তালিবের সমালোচনাকে ইসরায়েল রাষ্ট্র ধ্বংস করার আহ্বান বলে অভিযোগ তোলা হয়েছে। আর গাজা ইস্যুতে সমালোচনা করায় রাশিদার বিরুদ্ধে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে শাস্তি দেওয়ার দ্বিতীয় প্রচেষ্টা। এর আগেও তার বিরুদ্ধে এমন প্রস্তাব আনা হয়েছিল।
ইলহান ওমর : মার্কিন নির্বাচনে কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে তৃতীয়বারের মতো জয়ী হয়েছেন সোমালি মার্কিন নারী রাজনীতিক ইলহান ওমর। মার্কিন পার্লামেন্টে যে দুই মুসলিম নারী প্রথম সদস্য হওয়ার গৌরব অর্জন করেন তাদের একজন ইলহান ওমর। ইলহান ওমর মিনেসোটা রাজ্যের ডেমোক্রেটিক পার্টির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ফিফথ ডিস্ট্রিক্ট থেকে নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি ইসরায়েলপন্থি রিপাবলিকান প্রার্থী ডালিয়া আল-আকিদিকে বড় ব্যবধানে হারিয়েছেন। ডালিয়া আল-আকিদি একজন ইরাকি বংশোদ্ভূত অভিবাসী। তিনি নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ মুসলিম হিসেবে পরিচয় দেন। বিপরীতে ইলহান ওমর ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষে সোচ্চার। আল-আকিদি ইলহান ওমরকে হামাসপন্থি বলে আখ্যা দিয়ে থাকেন। চলতি বছর আগস্টে মনোনয়ন ভোট চলাকালে ইসরায়েলি গ্রুপ আমেরিকান ইসরায়েল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির (আইপ্যাক) আক্রমণের সম্মুখীন হন ইলহান ওমর। তা সত্ত্বেও তিনি প্রতিপক্ষ ডন স্যামুয়েলকে পরাজিত করে প্রার্থী মনোনীত হন। নির্বাচিত হওয়ার পর ইলহান ওমর নির্বাচনী প্রচারে কঠোর পরিশ্রমের জন্য তার সমর্থকদের ধন্যবাদ জানান
আন্দ্রে কারসন : ডেমোক্রেটিকের আন্দ্রে কারসন ইন্ডিয়ানার ৭তম ডিস্ট্রিক্টে নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। সেখানে তিনি রিপাবলিকান জন স্মিটজকে পরাজিত করেন। আন্দ্রে কারসন বরাবরই ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনের বিরোধিতা করছেন। ইসরায়েলিদের কর্মকাণ্ডকে অবৈধ এবং শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার অন্তরায় হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ২০২১ সালে ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা আয়রন ডোম কর্মসূচিতে অর্থায়নের বিরুদ্ধে যে ৯জন ভোট দেন তাদের একজন ছিলেন তিনি। ২০২৩ সালে ৫৬ জন ডেমোক্র্যাটের মধ্যে একজন ছিলেন তিনি, যারা ভোট দিয়ে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে ১৮০ দিনের মধ্যে সিরিয়া থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করতে বাধ্য করেছিলেন। ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর হামলায় তিনি সব সময় বিচলিত। তিনি মনে করেন, এ বিষয়ে মানবাধিকার রক্ষাকারীদের নীরবতা মানে হলো তাদের জবাবদিহি এড়ানোর একটি প্রচেষ্টা। তিনি নিজে এবং তার সহকর্মীদের পক্ষ থেকে বাইডেন প্রশাসনের প্রতি বারবার এই আহ্বান করেছেন যে, অবিলম্বে যেন তারা এই নিপীড়নের নিন্দা করে।
লতিফা সাইমন : ক্যালিফোর্নিয়ার ১২তম ডিস্ট্রিক্টের প্রতিনিধিত্ব করে লতিফা সাইমন নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে নির্বাচিত হয়েছেন। এতে মুসলিম প্রতিনিধিদের দল আগের চেয়ে ভারী হয়েছে। যা আমেরিকান মুসলিমদের প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী ভূমিকা পালন করবে। তিনি সান ফ্রান্সিসকোর উপসাগরীয় এলাকার একটি আইনজীবী কমিটির নির্বাহী পরিচালক এবং পূর্বে ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির বোর্ড অফ ট্রাস্টির নিয়োগকারী হিসেবে কাজ করেছেন।
তার নির্বাচন একটি বিখ্যাত মাইলফলক, যা কংগ্রেসে মুসলিম কণ্ঠের উপস্থিতি প্রসারিত করেছে। কাউন্সিল অন আমেরিকান ইসলামিক রিলেশন্সের গভর্নমেন্ট অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক রবার্ট ম্যাক বলেন, ‘লতিফা সাইমনের নির্বাচন একটি শক্তিশালী অনুস্মারক যে, আমেরিকান মুসলিমরা অগ্রসর হচ্ছে এবং কংগ্রেসের হলগুলোতে তাদের কণ্ঠস্বর উঁচু হচ্ছে। বিশেষ করে এমন সময়, যখন আমাদের সম্প্রদায়ের অনেকেই ক্রমবর্ধমান ইসলামফোবিয়ার ভার অনুভব করছেন। প্রতিনিধি কারসন, রাশিদা ও ইলহানের সঙ্গে তার উপস্থিতি আমাদের সম্প্রদায়ের স্থিতিস্থাপকতা এবং ন্যায়বিচারের প্রতি অঙ্গীকার প্রদর্শন করে। এই অর্জন প্রত্যেক আমেরিকান মুসলিমকে তাদের ইতিবাচক পরিবর্তন করতে এবং সমাজে অবদান রাখতে অনুপ্রাণিত করবে।’
আলজাজিরা ও ডন অবলম্বনে