লেখক: আবদুস শহীদ (যুক্তরাষ্ট্র)
প্রাচীন কাল থেকে বাংলা কবিতার ইতিহাসের পালাবদল লক্ষনীয়। কিছু কল্পনার অনুভূতি যখন হৃদয়কে স্পর্শ করে তখন কবি সত্তায় ভাবের সৃষ্টি হয়। কিছু সুনিপুণ শব্দবিন্যাসই কবিতার রূপ ধারণ করে। মানুষের হাজার বছরের নুয়েপড়া ইতিহাস, বুকফাটা ক্রন্দন, ধসেপড়া সভ্যতা, বিরহীর আশা ভঙ্গের অশ্রুধারা অতীত ও বর্তমান নিয়ে আধুনিক কবিদের কবিতায় উঠে আসছে।
কবিতা যে জীবনের কথা বলে,কবিতা যে নির্যাতনের কথা বলে,তার প্রকৃত রূপ আমরা দেখতে পাই ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামের উপভাষায় লেখা কবিতা ‘মিঞা’তে। এ কবিতাকে ঘিরে আসামের সর্বত্র পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে । এখানে কবিতাকে ঘিরে এক ধরনের সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টি হয়েছে আসাম রাজ্যের সর্বত্র।
তেমনি কাশ্মীরি সাহিত্যের হাজার বছরের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। কাশ্মীরি ভাষায় ব্যাপক ভাবে কবিতা ও সাহিত্য রচনা হয় সাড়ে সাতশো বছর আগে থেকে। মধ্যযোগ থেকে কাশ্মীরিরা উর্দু ভাষায় ও সাহিত্য রচনা করেন।কাশ্মীরি সাহিত্যের প্রথম দিকের কবিদের মধ্যে লালেশ্বরী অন্যতম।বিশ্বসাহিত্যে ও কাশ্মীরি বংশোদ্ভূত সাহিত্যিকদের মধ্যে আগা শাহিদ আলি, নিতাশা কৌল বেশ পরিচিত মুখ।
বর্তমানে কাশ্মীরে বসবাসকারী তরুণ কবিদের মধ্যে উর্দু র পাশাপাশি ইংরেজীতে বিদ্রুহী কবিতা লেখার প্রচলন রয়েছে।সাম্প্রতিক কবিতায় গত কয়েক বছরে বিভিন্ন অবরোধ চলাকালিন সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া কিছু ইংরিজী কবিতার বাংলা অনুবাদ তুলে ধরা হয়েছে। “ ওরা আমাদের অবরুদ্ধ করে রেখেছে,/ প্রিয় নিষেধাজ্ঞার গোপন কামরায়,/ এক আধমরা গুজব ভাসছে তুমি আসবে খুব শিঘ্রই।কারাদূর্গের ভিতর উন্মত্ত শয্যার পাশে/ আমরা এখন বন্দি কালো জাদুগরের হাতে।হাতকড়া পরিয়ে ওরা আমাদের দমিয়ে রাখতে চায়;।
মূলত কাশ্মীরে ঘটে চলা সামরিক বাহিনীর হাতে হত্যাকাণ্ডের উপর এই ধরনের বিদ্রূহী কবিতা গুলো বেশ কজন কবির কবিতার মধ্যে প্রতিবাদী লেখনী ফুটে উঠেছে।কবিতার মূল বিষয় স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, একাকীত্ব,আগ্রাসন।
দীর্ঘদিন থেকে আসাম রাজ্যের সর্বত্র তেমনি দানা বেঁধে উঠেছে কিছু কবির কবিতা। কবিতার মাধ্যমে প্রতিবাদী বিদ্রোহে ফেটে পড়ছে আসাম। সাম্প্রতিক আসামে “মিঞা”কবিতার কিছু অংশ স্বদেশী ভষায় লেখা,পাশাপাশি বাংলা অনুবাদে তুলে ধরা হয়েছে। “ লিখা/ লিখিলোয়া মই এজন মিঞা/ এনআরসির ক্রমিক নং ২০০৫৪৩/ দুজন সন্তানর বাপেক মই/ অহাবার গ্রীষ্মত লব আরো এজনে/ তাকো তোম ঘিন করিবা নেকি/ যিদরে ঘিন করু মোক ?। মূল কবিতাটি এমন,লিখ/ লিখে রাখ/ আমি একজন মিঞা/ এনআরসি-র ক্রমিক নং২০০৫৪৩/ দুজন সন্তানের বাপ আমি/ আগামি গ্রীষ্ম নাঘাত আরো একজন আসবে/ তাকেও তুমি কি ঘৃনা করবে/ যেমনটি করো আমাকে!
২০১৬ সালের শুরুতে আসামে সরকার বদল হয়। রাগ আর হতাশায় ড, হাফিজ আহমদ ফেইসবুকের পাতায় লিখলেন উপরিউক্ত কবিতা। এই কবিতার হাত ধরেই আসামের বুকে দানা বেঁধে উঠে আন্দোলন। ব্রম্মপুত্র এলাকায় মুসলিম তরুণ প্রজন্ম যাদের পূর্বপুরুষরা বাঙ্গালী ছিলেন,সেই নবীন কবিরা ফেইসবুকে একের পর এক ‘মিঞা কবিতা’ লিখতে শুরু করেন। ফেইসবুকের পাতায় ফুটে উঠে তাদর দীর্ঘদিনের যন্ত্রনার ইতিহাস।
‘মিঞা কবিতা’আসামের এক নতুন ধারার কবিতা। ভীষণ তীঘ্ন তার ভাষা, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে অপমান,বিদ্রুপ, শোষণ,নির্যাতন সবকিছুকে দাহ করে ব্রম্মপুত্রের চরাঞ্চলের মুসলিম যুবক যুবতীরা হাতে তোলে নিলেন কবিতার মশাল।শোষণ আর বিদ্রুপে মুসলিম যুব সমাজের মধ্যে এক নীরব বিপ্লব দানা বেঁধে উঠে। ’মিঞা’কবিতা গুলি তারই বহিপ্রকাশ।’
মিঞা কবিতা; একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জন্ম।এ কবিতাকে জানতে হলে আসামের রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাস জানা প্রয়োজন। প্রাচীনকাল থেকেই এই ক্ষুদ্র জনগুষ্টি ধর্ম,বর্ণ,ভাষা সংস্কৃতির সমন্বয়ে গঠিত।আসামের রাজনৈতিক সিমানা বারবার বদল হয়েছে। ফলে জনগুষ্টির মধ্যে ও পালা বদল হয়েছে। মোগলদের আগমন ও ঘটেছে এ রাজ্যে। ১৭৬৫ খৃষ্টাব্দে মোগল থেকে ইংরেজদের অধীনে আসে করিমগঞ্জ,ধোবলি, গোয়ালপাড়া এবং চিরাং জেলার কিছু অংশ। করিমগঞ্জ জেলা ছাড়া অন্যান্য সব জেলাকে ইংরেজরা অবিভক্ত রংপুর জেলার সাথে একত্রিত করে।
১৮৭৪ সালে সিলেট,কাছাড়,গোয়ালপাড়া এই তিনটি বাংলা ভাষাভাষী জেলাকে ঢাকা ডিভিশন থেকে কেটে এনে আসামের সাথে যুক্ত করা হয়। এবং এর ফলে বাংলা ভাষাভাষীরা সংখ্যাগরিষ্ট হয়ে উঠে। মুসলমানদের সংখ্যা ও দিন দিন বাড়তে থাকে। আবার আসামের জমিতে ফসল ফলানোর জন্য তৎকালীন পূর্ব বাংলা থেকে ভূমিহীন মুসলমান কৃষকের সংখ্যা ও আসামে চলে আসে।
১৯৪৭ সালে পাকভারত ভাগাভাগির সময় দেখা গেল বাংলা ভাষাভাষী মুসলমানরা সংখ্যা গরিষ্ঠ। তখন সিলেটকে বিভক্ত করে মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠকে পাকিস্তানের সাথে জোড়ে দেওয়া হয়।অনেক অবস্থাপন্ন হিন্দু ও সিলেট ছেড়ে আসামের উদ্বাস্তুতা গ্রহন করেন।
এক সময় বাংলাভাষিদের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় আসামি
জাতীয়তার কাছে এক অশনিসংক্ষেত হয়ে দেখা দিল। তাই আসামী নেতারা ছল,বল চাতুরি করে মুসলমানদের উপর আসামী জাতীয় ভাষা চাপিয়ে দিল। মুসলমানেরা সরকারি ভাবে আসামীয় মাতৃভাষাকে মেনে নিতে বাধ্য হল। এবং এরই ফলে ১৯৭১ সালের লোকগনণায় আসামের লোক সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬০.৪৯ শতাংশে। এবং অভিবাসী মুসলমানদের পরিচয় হয়ে দাড়ায় নব্য অসমিয়া।
১৯৭৯ সালে অসমিয় নেতা আসুর নেতৃত্বে শুরু হয় ;বিদেশী খেদাও; আন্দোলন।উগ্রপন্থী আসামিয়রা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে শ্লোগান তুলল বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরা আসাম দখল করে নিচ্ছে। ১৮৭৪ থেকে ১৯৪৭ এই দীর্ঘ সময়ের ইতিহাসকে অশ্বিকার করে আসু।যার ফলে এটা
অনেকটা সাম্প্রদায়িকতায় রূপ নেয়।
মিঞা,একটি উর্দু শব্দ।বহুল প্রচারিত এই শব্দটি
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে মুসলমানদের মধ্যে মিঞাএবং হিন্দুদেরকে বাবু বলে সম্মোধন করার নিয়ম চালু আছে। কিন্তু আসামে; মিঞা একটি গালি।আসামের অনেক স্থানে মুসলমানদেরকে মিঞা বলে গালি দেওয়া হয়। আসামী মুসলমানদের সাথে বাঙ্গালী হিন্দু ও আসামী মিলে মুসলমানদের উপর নির্যাতন চলে নিরন্তর।আসামীয়রা তিব্র ঘৃনা ছুড়ে দেয় এই মিঞা দের উপর।
মিঞা কবিতা’নির্মাণের প্রথম ধাপ ১৯৩৯ সালে। বন্দে আলি মিঞা,;এক চরোয়ার শপথ; নামে কবিতা দিয়ে এই ধারার যাত্রা শুরু।তারপর এই কবিতার ধারা দ্রুত জনপ্রিয় হতে থাকে।নেলীর গনহত্যা থেকে মুসলিম নারী দর্শনের কাহিনী এসব কবিতার বিষয়বস্তু হিসেবে উঠে আসে।’মিঞা কবিতা’লিখা চলতে থাকে একটা ধারাবাহিকতায় কেউ একটা কবিতা লিখলে তার সুত্র ধরে আরেকজন লিখল এই ভাবে এগোয় ।
কিন্তু এই ‘মিঞা কবিতা’নিয়ে আসামিরা মোটেই সন্তুষ্ট নয়।আসামের তিনসুকিয়া কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সুশান্ত কর মনে করেন, বিষয়বস্তু ও ভাষা দুইটার অমিলের কারনে এই সমস্যাটি হচ্ছে,তাই ‘মিঞা কবিতা’নিয়ে এত বিতর্ক।তাঁর মতে “ এক কনটেন্ট যেমন আসামিয় জাতীয়তাবাদকে চেলেন্জ করছে তেমনি এর ভাষার মধ্যে ও লুকিয়ে আছে আসামিয় ভাষা রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
কিছু দিন আগে আসামে প্রকাশ হতে যাচ্ছিল বিতর্কেত এনআরসি বা জাতীয় নাগরিকপুঞ্জির চুরান্ত তালিকা যাতে লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালী মুসলমান নাগরিকরা খোয়াতে পারেন ভারতীয় নাগরিকত্ব। সেই তালিকা প্রকাশের ঠিক পূর্বে মিঞা কবিতাকে নিয়ে উত্তেজনাকে আরো বহুগুন বাড়িয়ে তুলতে পারে। কবি কাজি নীলের একটি কবিতার অনুবাদ এমন- যদি আর কোন ভাষা থাকেনা পৃথিবীতে/ যদি হারিয়ে যায় সব অক্ষর মালা/ যদি ভেসে যায় খাতা কলম কবিতার উপমা/ যদি কোনও সাঙ্কেতিক ভাষায় না বলতে পারি তোমাকে আমার এই নীরব দু:খ/ এই মরে যাওয়া মন যদি না পায় গানের ঠিকানা / যদি না লিখা হয় চিঠি আগুন জ্বলা বসন্তে/ যদি বোবা হয়ে যাই,যদি আমাদের চোখ আর না বলে কোনও কথা/ কথা গুলো উডে বেডায় শিমুল তূলার মতন/ আর বুঝতে না পারি বুক ফাটা মেঘের বিষাদ/ ভালবাসার কথা কি আর বলবনা বল!
কাজি নীলের লেখা মিঞা কবিতা “যে দেশ আমার বাবাকে বিদেশী বানায়/ যে দেশ আমার ভাইকে গুলি করে মারে/ যে দেশে আমার বোন মরে গণধর্ষণে/ যে দেশে আমার মা বুকে আগুন চেঁপে রাখে/ সেই দেশ আমার আমি সেই দেশের না।/ যে দেশে লুঙ্গী পরার অধিকার নাই/ যে কান্না শুনার মানুষ নাই / যে দেশে সত্য বললে ভূতে কিলায় / যে দেশ আজীবন আমার দাসত্ব চায়/ সেই দেশ আমার আমি সেই দেশের না। এই কবিরা এখন গা ঢাকা দিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে আছেন।পুলিশ এখন জনাদশেক কবিকে খুঁজছে।
এদিকে বর্তমান শাসক দল বিজেপি ও আসামের কিছু চিন্তাবিদ মুখ খুলেছেন মিঞা কবিদের বিরুদ্ধে।