রমজান মাসে ইফতার ও সেহরিতে কী খাবেন আর কী খাবেন না, সেটা বুঝতে পারেন না অনেকেই। দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকার পর সেহরি এবং ইফতারে কী খাবেন আর কী বর্জন করবেন, সেদিকে দিতে হবে বিশেষ নজর। পরামর্শ দিয়েছেন পুষ্টিবিদ নিগার সুলতানা
খাবার তালিকায় অবশ্যই রাখবেন খেজুর। সেহরি ও ইফতার দুটি সময়ের জন্যই খেজুর খুব পুষ্টিকর একটি খাবার। এতে আছে শর্করা, সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম, আয়রনসহ প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান। এ ছাড়া গ্লুকোজ ও ফ্রুক্টোজের খুব চমৎকার একটি সংমিশ্রণ এটি। অর্থাৎ খেজুরের একটি অংশ থেকে আমরা অতিদ্রুত শক্তি পাই। আবার কিছু অংশ ধীরে ধীরে দীর্ঘ সময় ধরে শরীরে শক্তি প্রদান করতে থাকে।খেজুরের পর অনেকেই চিনির শরবত বা জুস খান। চিনির এই শরবতের বদলে সাদা পানি পান করুন। সুযোগ থাকলে ডাবের পানি পান করা যেতে পারে। ডাবের পানিতে থাকা পটাশিয়াম সারা দিনের পানিশূন্যতা খুব দ্রুত পূরণ করে দেয়। এ ছাড়া বাসায় বানানো ফলের জুস পান করা যেতে পারে। তবে চিনি ব্যবহার করা যাবে না এবং দোকান থেকে কেনা জুস বর্জন করুন।
এরপর ইফতারে পছন্দমতো ফল খেতে হবে। এক মাসব্যাপী রমজানের নির্দিষ্ট কোনো ফলের পরিবর্তে আপনার বাজেটের মধ্যে পড়ে এমন ফলমূল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খান। কারণ নানা রকম ফল থেকে আমরা নানা রকম পুষ্টি উপাদান পাই।
ইফতারের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ পেঁয়াজু-বেগুনি। যা আমরা ডুবো তেলে ভেজে খাই এবং রিফাইন তেল ব্যবহার করি। ডুবো তেলে ভেজে খাওয়ার কারণে এই খাবারগুলো ট্রান্স ফ্যাটে পরিণত হয়। ট্রান্স ফ্যাটে হলো সব থেকে বিপজ্জনক ফ্যাট। এই ফ্যাট অল্প পরিমাণে খেলেও অনেক ক্ষতি হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, আমরা সারা দিনে যে পরিমাণ ক্যালরি খাই তার ২ শতাংশ যদি ট্রান্স ফ্যাট থেকে আসে তাহলে হার্টের রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এমনকি কোলেস্টেরল, ফ্যাটি লিভারের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ ছাড়া এই তেল আমাদের শরীরে প্রদাহ সৃষ্টি করে। এ ছাড়া তেল ব্যবহারে রাখতে পারেন সরিষার তেল, অলিভ অয়েল, নারকেল তেল, ঘি বা বাটার। ডুবো তেলে ভেজে খাওয়ার পরিবর্তে হালকা ভাজা অর্থাৎ শ্যালো ফ্রাই করে খেতে পারেন। সব থেকে ভালো এয়ার ফ্রাই করা খাবার খেলে।
নিয়মিত দই, চিড়া, কলা খেতে পারেন। এতে আছে শর্করা, প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, ফ্যাটসহ অন্যান্য পুষ্টি উপাদান। যা শরীরকে ঠান্ডা রাখে। ভিন্নধর্মী খাদ্যাভ্যাসের কারণে রোজায় অনেকের হজমের সমস্যা দেখা দেয়। ইফতারে দই ডাইজেস্টিভ হেলথকে রক্ষা করতে সহায়তা করে। ডায়াবেটিস রোগীরা কলা এড়িয়ে যাওয়া ভালো।
রোজায় নিয়মিত খেতে পারেন ছোলা। ১৫০ গ্রাম ছোলাতে প্রায় ১৫০ কিলোক্যালরি শক্তি আছে। এর থেকে আমাদের দৈনিক খাদ্য আঁশের চাহিদার প্রায় ৪০ শতাংশ পেতে পারি। এ ছাড়া প্রোটিন, মিনারেল, ফাইবারসহ এতে আছে নানা পুষ্টি উপাদান। যারা ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে চান বা রোজার মধ্যেও ব্যালান্স ডায়েট করতে চান তারা ছোলা সেদ্ধ করে অল্প তেলে সামান্য মসলা দিয়ে মুরগির মাংস ও ডিমের সাদা অংশ মিশিয়ে খেতে পারেন। এভাবে রান্না করে খেলে অতিরিক্ত তেল শরীরে লাগে না। এতে ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে।
সারা দিন রোজা থাকার পর ইফতারে একবারে অনেক খাবার খাওয়া উচিত নয়। সামান্য খাবার খেয়ে একটা বিরতিতে যাওয়া উচিত। এতে আমাদের মস্তিষ্ক শরীরকে সিগন্যাল পাঠাতে পারে, যাতে বেশি খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকা যায়। একবারে অনেক খাবার খেয়ে ফেললে একদিকে যেমন গ্যাসের সমস্যা হতে পারে অন্যদিকে যারা ওজন কমাতে কম ক্যালরি গ্রহণ করতে চান তাদের বিশেষ উপকারে আসে না। এজন্য একটা বিরতি নিয়ে স্বাস্থ্যকর উপায়ে রান্না কম তেল-মসলায় রান্না করা খাবার গ্রহণ করা যেতে পারে।
সারা দিনের পানির চাহিদা মেটাতে খেতে হবে পর্যাপ্ত পরিমাণে তরল খাবার। দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকার পর পানি খাওয়া অনেক সময় কষ্টকর হয়। তাই খাদ্যতালিকায় রাখতে হবে যেকোনো তরল খাবার। সেটি হতে পারে স্যুপ। তবে বাজারের কেনা প্যাকেটজাত নয় বাড়িতে বানিয়ে স্যুপ খেতে হবে। অন্তত দুই থেকে আড়াই লিটার পানি খেতে হবে। পানির পরিমাণ একবারে অতিরিক্ত বা বেশি পানি খাওয়া যাবে না। ইফতারে দুই-তিন গ্লাস পানিই যথেষ্ট। তবে ইফতারের পর সেহরি পর্যন্ত প্রতি ঘণ্টায় এক গ্লাস করে পানি পান করা উচিত। প্রয়োজনবোধে আরও বাড়ানো যেতে পারে।
রাতের খাবার অনেক রাত না করে ইফতারের এক-দেড় ঘণ্টার পরে করে নিতে পারেন। রাত ১১টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়তে পারলে ভালো। যেন ঘুম ভালোমতো হয়, আবার সেহরির সময় ইবাদতের জন্য এবং খাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে সময় থাকে।
সেহরিতে কী খাওয়া হবে, তা নিয়েও দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়তে হয়। যেহেতু পরের দিন টানা একটা সময় খাবার গ্রহণ করা হবে না, তাই সেহরির সময় খাবারের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। সেহরির খাবার মেনুতে রাখতে পারেন লাল চালের ভাত, ওটস, মাছ কিংবা মাংস, বাদাম রাখতে পারেন এক-এক দুইটা, কুসুমসহ ডিমও রাখতে পারেন। শাকসবজি, ঘন ডাল, সালাদ রাখতে পারেন মেনুতে। গ্যাসের সমস্যা এড়াতে খাওয়ার পর কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করতে হবে। চেষ্টা করবেন সেহরির সময়ের খাবারের পর যেন হাতে কিছুটা সময় থাকে। এতে খাবার পরে একবারে অনেক পানি না খেয়ে একটু বিরতি দিয়ে দিয়ে দুই-তিন গ্লাস পানি পান করতে পারেন। রোজার মাসে ব্যায়ামের ক্ষেত্রে ইফতারের আগে এবং ইফতারের ঘণ্টা খানেক পর ব্যায়ামের জন্য উপযুক্ত সময়।