প্রকৃতির পালা বদলের নিয়মে মৌসম আসে আর যায়। আমাদের এখানে শীতের বাতাস বইতে শুরু করেছে। যুক্তরাজ্যে গ্রীষ্মকাল শেষে শীতের আগমনী সময়কে স্থানীয় ভাবে ফল (fall) বলা হয়। এ সময় শুরু হয় প্রকৃতির রূপ বদলের পালা। শীতকে বরণ করার জন্য প্রকৃতি তখন বর্ণিল। এই ঋতুতে শুরু হয় পাতা ঝরার দিন।
আমি জানালা দিয়ে দেখি সবুজ গাছগুলো ক্রমেই হলুদ, কমলা, লাল এবং বাদামি বর্ণ ধারণ করে বাতাসের সাথে হেলে দুলে ঝরে, ঝরে শীতের আগমনী জানান দিচ্ছে। ঝরে যাওয়া রংবেরঙের গাছের পাতার সাথে সাথে বাতাসে শীতের উষ্ণতা অনুভব করা যাচ্ছে।
ইংল্যান্ডে শীতকাল মানেই বেশিরভাগ সময়ই হিটার জ্বালিয়ে ঘরের ভিতরে থাকা। খুব প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যাওয়া হয়না। এত শীতে বাইরে যেতে ইচ্ছে না করাটাই স্বাভাবিক।
গতকাল আলতো শীতের বাতাসের সাথে খুব সুন্দর জলমলে রোদ্রজ্জল একটি দিন ছিল। তীব্র শীতের চাদরে চারিদিক আবৃত করে নেওয়ার আগে কিছুক্ষণ আমার অতি প্রিয় সমুদ্রের পাশে বসে সময় কাটানোর এই সুযোগটাকে আমি হারাতে চাইনি।
তাই ফ্লাক্স ভর্তি চা আর গল্পের বই হাতে নিয়ে চলে গেলাম সমুদ্রের পাড়ে। গিয়ে বসলাম আমার প্রিয় জায়গাটায় যেখানে আমি সব সময় বসে সমুদ্র দেখি। তবে ভীষণ বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করলাম আজ আমার অতি চেনা প্রিয় জায়গাটাকে যেন প্রকৃতি অন্যভাবে সাজিয়ে রেখেছে।
সমুদ্রের ঢেউ আর বাতাসের শব্দ ছাড়া চারিদিকে যেন পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। সমস্ত সাগর পার জুড়ে কোন জনমানব নাই শুধুমাত্র সামনে বিশাল সাগর, উপরে নীল আকাশ আর আমি । নীল আকাশের বুকে, ফালি ফালি মেঘের সাজে সজ্জিত উজ্জ্বল সূর্য।
উজ্জল সূর্যটা ঝলমলে হাসি হেসে আমাকে যেন সাদর আমন্ত্রণ জানালো। সাগরের ঢেউয়ের সাথে হিম হিম হালকা ঠান্ডা বাতাস। মাথার উপর প্রফুল্ল সূর্যের তাপে সেই শীতল বাতাসকে বেশ আরামদায়ক করে তুলেছিল তবে কিছুক্ষণ পর পর মেঘ বালিকারা সূর্যকে সাদা চাদরে আড়াল করে ফেলছিল।
আকাশের বুকে ঘুরে বেড়ানো মেঘ আর সূর্যের লুকোচুরি খেলা বিমুগ্ধ হয়ে উপভোগ করছিলাম। হঠাৎ প্রজ্জ্বলিত আকাশের বুক থেকে টিপ টিপ বৃষ্টির ফুটা অনুভব করলাম ভীষণ অবাক হচ্ছিলাম কারণ এদিকে এতো রোদ অন্যদিকে বৃষ্টি..! আল্লাহ তাআলার রহমত বর্ষণ হচ্ছিল।
এইভাবে হঠাৎ বৃষ্টির ছোঁয়া পেয়ে পরিতৃপ্তি নিয়ে সবকিছু গুছিয়ে ফিরে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছি তখনই বৃষ্টি পড়া বন্ধ হয়ে যায়।
হঠাৎ বৃষ্টিকে বিদায় দিয়ে শুরু হয় আবার ও সমুদ্র আর নীল আকাশের সাথে মিতালী। আজ কেন জানি অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল নীল আকাশকে। আকাশের বুকে টুকরো টুকরো মেঘের ভেলায় চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম সমস্ত আকাশ জুড়ে। মেঘের ভেলায় করে ঘুরে বেড়ানো শেষ করে এবার গল্পে আর গানে মেতে উঠলাম সমুদ্রে উত্তাল ঢেউয়ের সাথে..
সমুদ্রের বুকে ছোট ছোট ঢেউ এলোমেলো খেলা করছিল। আমি ঢেউয়ের পাশে দিয়ে হেঁটে হেঁটে হেডফোন লাগিয়ে প্রিয় গানগুলো শুনছিলাম। আশেপাশে কেউ নাই তাই আমিও গুনগুনিয়ে গান গেয়ে সমুদ্রকে শুনলাম। সমুদ্রের অভিনব আচরণে বুঝা গেল প্রকৃতির সাথে মিশে গিয়ে মনের আনন্দে গলা ছেড়ে আমার গাওয়া গান তাঁদের পছন্দ হয়েছে।
প্রকৃতির মাঝে মিশে গিয়ে অসাধারণ সুন্দর একটি দুপুর কাটালাম। এত মনোরম ভাবে সেজেছে আজ প্রকৃতি। প্রকৃতির এই রমণীয় রূপ মাঝে মাঝে আমাদের নিস্তব্ধ ও নির্বাক করে দেয়।
প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই যুগে একঘেয়ে-কর্মব্যস্ত জীবনে খানিকটা স্বস্তি এবং মানসিক প্রশান্তির জন্য প্রকৃতির সাথেই আমাদের বন্ধুত্বে মেতে থাকতে হবে। কারণ একমাত্র প্রকৃতিই আমাদেরকে নিঃস্বার্থভাবে অফুরন্ত আনন্দ দান করে।
মহান আল্লাহতালার কাছে হাজার শুকরিয়া অফুরন্ত আর অগণিত নিয়ামত দান করার জন্য। আলহামদুলিল্লাহ।
লেখক: মরিয়ম চৌধুরী (যুক্তরাজ্য)