বুধবার, ৪ঠা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

হায় ফেসবুক- হায় সংসার

             লেখক: কাজী ইসলাম (যুক্তরাষ্ট্র)

বাসায় ঢুকেই আদনান ফায়সাল ওরফে হাবলু বুঝে গেল আবহাওয়া চরম দুর্যোগূর্ণ। বজ্র বিদ্যুৎ সহ ঝড়বৃস্টি হতে পারে, টর্নেডোও হতে পারে, এমন কি হতে পারে ভূমিকম্পও।আদনান ফায়সালের মত এমন আধুনিক নামের চৌকশ তরুণের ডাক নাম হাবলু হয় কেমন করে? আমার মনে হয় ছোটবেলায় হা- – আ- – করে খালি কাঁদতো বলে বাবা- দাদি সব ওকে হাবলু  বানিয়ে ছেড়েছে, বড় হলে এটা যে ওর প্রেস্টিজে লাগতে পারে সেটা ভাবেই নি কেউ। আর এমনি কপাল, ওর হাবলু নামটাই বড় হয়েও বহাল থেকে গেল। বন্ধুমহল তো বটেই, ওর শশুর- শাশুরি পর্যন্ত ওকে হাবলু ডাকে।

হাবলুর স্ত্রী, যে কিনা এইমাত্র ডোরবেল বাজানোর পর দরজাটা খুলে দিয়ে বিদ্যুৎ ঝলকের মত ভ্যানিশ হয়ে গেল, কোথায় আল্লাহ মালুম।হাবলুর স্ত্রী রিনিশা জিনি কেটি। ঘাবড়াবেন না, বিদেশি নয়, বাঙালিই। কাবিনে নাম আছে রওশন জাহান খাতুন, ফেসবুকে নাম নিয়েছে রিনিশা জিনি কেটি।

“ সকাল থেকে আমি পাঁচটা পোস্ট দিয়েছি ফেসবুকে, একটাও তুমি লাইক দাও নি, কমেন্ট তো দূরের কথা। দেখোই নি আসলে। আর আমার বান্ধবীরা, তাদের স্বামীরা, আমার চাচাতো দুলাভাই, সবাই মিলে ৫৯ থেকে ৯৫ টা লাইক দিয়েছে, রিয়্যাকশন ইমোটিকন, কমেন্ট সহ। তোমার বোন “ আমি আজ ডিম ভেজেছি” ছবি সহ পোস্টে অসভ্যের মত হাহা দিয়েছে , আবার কমেন্ট করেছে ‘ really ভাবী, তুমি ডিম ভাজতে পারো?’ কত বড় অসভ্য । প্রথম রাউন্ড বর্ষন হলো, গর্জন সহ।

হাবলু তাড়াতাড়ি মোবাইল বের করে। ফেসবুক নোটিফিকেশন বন্ধ রেখেছিল অফিসে ঢুকেই। আজ জরুরী মিটিং ছিলো। পরে অন করতে ভুলে গেছে।দেখলো এখন, ডিম ভাজার পোস্ট , বিড়ালকে শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করানোর পোস্ট, রাস্তা দিয়ে একটা নেড়ি কুত্তা যাচ্ছিল সেটার ছবি সহ পোস্ট , জব্বর ক্যাপশান সেটার “একাকী পথিক”। How cute কমেন্ট পর্যন্ত পড়েছে এটাতে।এই জাতীয় আরো দুইটা।লাইক বেশিরভাগই লাল হৃৎপিণ্ড শোভিত।

হাবলু  ছেলে ভালো, বিস্তর বাবু, জানু, জানটু ইত্যাদি বলে এবং আর এমন ভুল হবেনা প্রতিজ্ঞা করে মানভন্জন পর্ব সারে। রওশন , স্যরি রিশিনাও খুব ভালো মেয়ে। খুব দ্রুতই ওর রাগ পড়ে যায় ।খুশি হয়ে হাবলুর জন্যে হাবলুর প্রিয় নাস্তা আনিয়ে দেয় পাড়ার ফার্স্ট ফুডের দোকান থেকে।

হাবলু ম্যানেজ করে ভালোই চলছিল। বেশ সার্কাসের দড়ির ওপর হাঁটার মত অফিস এবং ফেসবুকে রিশিনাকে রেসপণ্ড করা চালিয়ে যেতে পারছিল। শুধু হুঁশিয়ার থাকে, অফিসে ফেসবুক করা য বস্ যেন বুঝতে না পারেন ।একটা টেকনিক আবিষ্কার করেছে। কতগুলো কমেন্ট লিখে নোটস্ এ সেভ করে রেখেছে। যেমন Awsum, beautiful, wow, amazing, বাহ্ সুন্দরতো, আলহামদুলিল্লাহ, মাশাল্লাহ্ এইসব। রিশিনার পোস্ট দেখলে লাইকে লাল হৃৎপিণ্ড দিয়ে চট করে নোটস্ থেকে কপি করে কমেন্টে গিয়ে পেস্টকরে সেণ্ড ব্যস বৌ খুশি, অটল শান্তি।

একদিন বিতং হয়ে গেল! অফিসে হাবলুর কাষ্টমার নিয়ে কারবার।এবং কাস্টমাররা একেকজন সবসময় মার মার কাট কাট মুডে থাকে।মাথা ঠাণ্ডা রাখা কঠিন। মাথা যখন খুব গরম হয় তখন চাঁদির ওপর আইসব্যাগ ধরা আছে, মেডিটেশনে এমন দৃশ্য তৈরি করে হাবলু ।মেডিটেশনের একটা কোর্স করা ছিল ওর।তো একদিন একটা কাস্টমার মাথা গরম করে দিয়েছে। মেডিটেশনে বরফ দিয়েও লাভ হচ্ছে না। প্রানপনে নিজেকে নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা করছে , তখনই ফেসবুকে নোটিফিকেশন এবং রিশিনা খাতুন, থুড়ি রিশিনা কেটির একটা পোস্ট।অত্যন্ত দ্রুত রিফ্লেক্সে রেসপণ্ড করলো হাবলু। লাভ ইমোটিকন দিয়ে লাইক মেরে ফটাফট একটা কমেন্ট কপি পেস্ট করে সেণ্ড করে দিল।

হা ক্লান্ত হয়ে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে দেখে দরজায় তালা,তারমধ্যেএকটা চিরকুট,“ তোমার মত অমানুষের সঙ্গে সংসার করা সম্ভব না। সায়ানারা, আল বিদা।”

দুইঘন্টা পর হাবলু শশুর বাড়িতে বিচারের সম্মুখীন । বাদী-বিচারক-তদন্তকারী-প্রসিকিউটর সবই রিশিনা জিনি কেটি।শশুর-শাশুরি খুব বেশি হলে আমেরিকার বিচার ব্যবস্থার মতো জুরী বলা যেতে পারে। শালা-শালীরা দর্শক।

অভিযোগ গুরুতর! রিশিনা ফোনে তার ফেসবুক একাউন্ট ওপেন করে। সকাল ১১,৩৭-এ একটা পোস্টে করুন মুখের রিশিনার ছবি, ওপরে ক্যাপশান ‘ সকাল থেকে আমার জ্বর,মনে হয় আমার করোনা ভাইরাসের আক্রমণ হয়েছে।’ ১৫২টা বিভিন্ন কিসিমের লাইক ও সংবেদনশীল আহা-উহু কমেন্ট।কলেরা হাসপাতালে ভর্তি হবার উপদেশও আছে। প্রথম রিয়্যাকশন এবং কমেন্ট  হাবলুর । রিএ্যাকশনে লাভ ইমোটিকন। কমেন্টে লেখা ‘আলহামদুলিল্লাহ্’।স্টক করা কমেন্ট থেকে কপি পেস্ট করতে যেয়ে গুবলেট হয়ে এমন গজব।

হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে রিশিনা জিনি কেটি, একেবারে রওশন জাহান খাতুনের মত করে। “বাবা, তুমি এমন একটা অমানুষের সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়েছিলে!” হাসি চেপে গম্ভীর হতে যেয়ে বাবার মুখ আরো কিম্ভুত দেখায়।বিচার পর্ব শেষ হতে রাত বারোটা বাজে।

বহু বিতং এবং বিতণ্ডা হলো । রিশিনার দুই দফায় দাঁত কপাটি লাগলো। এক পর্যায়ে জ্ঞান ফিরে মড়া কান্না শুরু করে দিল।বিরক্ত হয়ে হাবলুর শশুর বল্লেন ,” এই কান্না আমি মরার পরে কাঁদিস। এখন খেয়ে দেয়ে বাড়ি যা।আর হ্যাঁ,যাবার আগে তোদের দুজনের স্মার্ট ফোনদুটো আমার কাছে জমা দিয়ে যাবি আর আমার আর  তোর মা’র বোতামটেপা ফোন নিয়ে যাবি।সাতদিন পর আবার বিচার বসবে,এই সাতদিন নো ইন্টারনেট,নো ফেসবুক ।”শোনামাত্র রিশিনা আবার অজ্ঞান!

যাহোক হাবলুর শাশুড়ি জানেন যে তাঁর কন্যারত্নের কারণে হাবলুর খাওয়া দাওয়ার খুব কষ্ট হয়।সোনার টুকরো ছেলে,রওশন যা ছাইপাঁশ দেয় সোনামুখ করে তাই খায়।অতএব আজকে জামাইকে জম্পেশ একটা ডিনার খাওয়ালেন।এবং খাবার পর হাবলুর মনে হলো এমন চমৎকার রান্নার জন্য তার শাশুড়ির অনেক আগেই বাংলা একাডেমির সাহিত্য পুরস্কার পাওয়া উচিৎ ছিল।

দুজন এখন রিক্সায়। এত রাতেও ঢাকার রাস্তায় কোন বিপদ নেই।করোনার মৌসুম, হাইজ্যাকাররা রাস্তার কর্নারের ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে ঘরের কোনে কোয়ারিন্টাইনে আছে। ছিনতাই করতে গেলে অন্যের মোবাইল,মানিব্যাগ ধরতে হবে,কার করোনা আছে কে জানে।।রাস্তায় পুলিশ ভাইরাও নেই, উনারাও বোধহয় উনাদের কোয়ার্টারে কোয়ারেন্টাইনে আছেন।

শহরতলী অন্চল।চমৎকার জ্যোৎস্না ভেজা ফাল্গুনের রাত।কদিন আগেই দোল পূর্নিমা গেছে কিন্তু চাঁদের যৌবন এখনো যায় নি।হাল্কা দখিনা বাতাসে বসন্ত রাতের মাদকতা আরো ছলকে উঠছে । রিশিনা ঘাড় গোঁজ করে শক্ত হয়ে বসে আছে। চাপা রিক্সার মধ্যেও আরো একটু কাছ ঘেঁসে বসে হাবলু,নিচু স্বরে বলে,”রিশু”।রিশু আরো সরে বসে,( বেচারি কোথায় আর সরবে।) ”জানটু”। উঁহু, নো রেসপন্স। ‘বাবু’ ,নাহ্ ,অটল গাম্ভীর্যে কোন ফাটল দেখা গেল না।পাগলী ! (সরি,এই গোপন বিশেষ সম্বোধনটা প্রকাশ করে ফেললাম)।একটু কি শিথিল হলো শক্ত শরীরী ভঙ্গি?

“ফেসবুকে দেখে তোমাকে আমার ভালেবাসা বুঝতে হবে রওশন?”আবেগের বসে প্রায় বলেই বসেছিল “ তোমার রান্না প্রতিদিন তিনবেলা খাই, এটাযে ভালোবাসার কতবড় পরীক্ষা দেয়া-“ শেষ মূহুর্তে জবানে ইমারজেন্সি ব্রেক কষে সামলে নেয়।গাঢ় হয় হাবলুর গলা,”আমার কথায়, আচরনে , শরীরীভাষায় বোঝোনা আমি তোমাকে কত ভালোবাসি! ফেসবুক তো একটা ভার্চুয়াল জগৎ, কল্পনার সিমুলেশন। সেটা কি রক্তমাংসের মানুষের মাটি ছুঁয়ে দাঁড়ানো জীবনের বিকল্প হতে পারে! ভিডিও গেমে গাড়ি চালানো আর বাস্তবে চালানোর আনন্দ কি এক? আমরা কি পরস্পরকে ছুঁয়ে, নিজের মুখে নিজের ভাষায় বলতে পারিনা ‘ভালোবাসি‘।তোমার জ্বরের কথায় আমি আলহামদুলিল্লাহ বলতে পারিনা, এটা বোঝোনা? বোঝোনা আমি তোমাকে কত ভালোবাসি? “

আবেগে ভিজে আবছা হয়ে যায় হাবলুর গলা।রোবটতো নয় রক্তমাংসের মানবী, আর ঐ  পাগলী সম্বোধন বরফ অনেকটা গলিয়েই এনেছিল।মুখ ফস্কে বলে বসে,”বুঝিতো!” ব্যস হাবলুর কেল্লা ইয়াহুউ -উ  বলে চীৎকার দিয়ে রিক্সা থেকে লাফ দিতে যায়। ভয়ে প্রানপনে জড়িয়ে ধরে রওশন, অথবা রিশিনা।এরপরের ঘটনার বর্ণনা নিস্প্রয়োজন। অভিমানের কালো মেঘ উড়ে গেল আকাশে। আর চাঁদটা যেন নিজেই লজ্জাপেয়ে নাকি ওদের একটু আড়াল দিতেই একটা ছোট মেঘ পেয়ে তার আড়ালে লুকিয়ে পড়লো।

এখানে শেষ করতে পারলে ভালো হতো। তবে আরেকটু আছে কাহিনীর। এখন হাবলু আর রওশন কেউ আর স্মার্ট ফোন ব্যবহার করেনা ।ফেসবুকে যায় সপ্তাহে একদিন, ছুটির দিনে ল্যাপটপে। রওশনের রান্নার দারুন উন্নতি হয়েছে ইদানীং।এবং হাবলুর শশুর আজকাল প্রায়ই খেতে আসেন হাবলুদের বাসায়।উনার খাওয়া দাওয়ার খুব কস্ট। সেদিন হাবলু- রিশিনার বাজেয়াপ্ত করে নেয়া ফোন দুটোর একটা হাবলুর শাশুডি করায়ত্ত করেছেন এবং ফেসবুক রপ্ত করে ফেসবুকে ফেঁসে গেছেন। হাবলুর শাশুড়ির আর রান্না-বান্না-সংসারে  মন নেই। সারাক্ষণই ফেসবুকে পড়ে থাকেন। বড় কস্ট এখন হাবলুর শশুরের!!

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১৩
১৫১৬১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
৩০৩১