মঙ্গলবার, ৩রা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

৯/১১ একটি রক্তক্ষরণের দিন

১৯৮৯ সালে আমেরিকায় পাঁ রাখার পরপরই মাথায় ছিল পৃথিবী খ্যাত নিউইয়র্ক এর ওয়ালট্রেড সেন্টার দেখার। ১১০ তলা বিশিষ্ট আকাশ চুম্বি এই টুইনটাওয়ার। শুনেছি ওয়াল্ড ট্রেড সেন্টারে ১০৭ তলায় উইন্ডস অব দি ওয়াল্ড নামে একটা রেষ্টুরেন্ট। ওখানে নাকি বেশ ক জন চাঁদ কপালি বাংলা দেশী ওয়েটারের কাজ করেন। শুনেই যেন মনে হলো দেখা পেলে তাদের কপালের সাথে কপাল ঠুঁকে দোয়া চাইতাম। কিন্তু এতবড় নিউইয়র্ক সিটি কে কোথায় থাকে তার কি হদিস আছে ? শেষ পর্যন্ত স্বপ্ন পোষণ করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকলো না কিন্তু টুইনটাওয়ার দেখার ইচ্ছে মনেই রয়েগেল।পরিচিত যাকেই দেখি বলি, চলেন ভাই ওয়াল্ড ট্রেড সেন্টার দেখতে যাব। সবাই বলে কাজ আছে।কারো ছুটির দিনে আমার ও কাজ থাকে।এভাবে চলে যাচ্ছে। ১৯৯৩ সালে আমার এক স্বজন আসলেন লন্ডন থেকে। আলাপে বুঝা গেল লন্ডনের পাঠ চুকিয়ে সুবিধা পেলে আমেরিকায় সেটেল্ড হাওয়ার ধান্দা। একদিন আমাকে জানালেন আমেরিকার বিখ্যাত স্থাপনা গুলো দেখার খুবই সখ। আমি মনে মনে খুবই উতফুল্ল হলাম, যাক এতদিন পর চমৎকার স্থান গুলো দেখার একজন সঙ্গী পাওয়া গেল। একদিন সুযোগ মতো সকালে দুজন বেড়িয়ে পড়ি। আগেই জেনে নিলাম পাতাল ট্রেনের E বর্ণমালার ট্রেনটি ওয়াল্ড ট্রেড সেন্টার পর্যন্ত যায়। ট্রেন থেকে নেমেই কিছু দূর এগিয়ে চলেগেলাম গন্তব্যে।এলিভেটরে ঢুকেই মনে হল এত উঁচুতে উঠতে না জানি কতক্ষন গেলে যাবে, কিন্তু না মনে হল মূহুর্তেই এলিভেটর নামক একটি ঘর দন্ডায়মান সব দর্শনার্থী নিয়ে উঠে গেল ১০৮ তলায়।এর উপরে উঠার নাকি নিয়ম নেই। ঐ দিন ছিল রুদ্রোউজ্জল সকাল কিন্তু ১০৮ তলা থেকে নিচে তাঁকিয়ে দেখি আকাশ আর জমিন একেবারে ধোঁয়াশা। মাঝেমধ্যে পিপিলিকার সারির মতো গাড়ি গুলোর লাইন দেখা যায়।দূর থেকে আসা বিমান দেখে মনে হয় এই বুঝি বিল্ডিং এর সাথে বেঁজে গেল। সাড়াক্ষন মনের মধ্যে একটা ভয় যেন কাজ করছে আর ভাবছি নির্ধারিত সময়টা এত লম্বা কেন।এভাবেই ওয়াল্ড ট্রেড সেন্টার দেখা।

এই ওয়াল্ড ট্রেড সেন্টার বা টুইনটাওয়ার মুহূর্তেই ধূলোয় মিশে যাবে তা ছিল কল্পনার ও অতীত। ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর ঘুম ভাংলো সকাল ৭ টায়।আগে থেকেই তারিখ ও সময় নির্ধারিত ছিল আমার ছোট মেয়ের ডাক্তারের এপোয়েন্টমেন্ট, তা ও আবার ম্যানহাটনে। সকাল সাড়ে নটায় সময় নির্ধারিত থাকলেও আধা ঘন্টা পূর্বেই পৌছতে হবে। তাই পুরনো অভ্যেস অনুযায়ী টিভি দেখতে দেখতে নাস্তা করছিলাম। ইতিমধ্যে মেয়ে হয়ত বের হবার প্রস্তুতি নিচ্ছে।ও মা টিভির স্কীনে নজর দিতেই অবিশ্বাস্য কিছু একটা ভেসে উঠল টিভির পর্দায়। নিজের চোখ কে ও যেন বিশ্বাস হচ্ছেনা আমি টিভি দেখছি, না হলিউডের কোন মুভি দেখছি। একটা ঘোরের মধ্যে কতক্ষন ছিলাম তা বলা যাবেনা। মেয়ের ডাকে আমার ঘুম ভাঙ্গালো, বললো আজ আর ডাক্তারে যাওয়া হবেনা কারন তার এক বান্ধবী নাকি জানিয়েছে ম্যানহাটনের কোথাও আগুন লেগেছে। তাই পাতাল রেল সহ সকল যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। তখন মেয়েকে টিভির দিকে ইশারা করে বললাম, একটি বিমান দুর্ঘটনার কবলে পরে টুইনটাওয়ারে আঘাত করেছে। কথা বলতে না বলতে দ্বিতীয় বিমানটি একই ভাবে টুইনটাওয়ারের দ্বিতীয় টাওয়ারে আঘাত করে এবং সাথে সাথে ধাউ ধাউ করে আগুন জ্বলতে থাকে। তখন আর বুঝতে দেরী হলনা যে এটা সাধারণ দুর্ঘটনা নয় এটা সন্ত্রাসী হামলা।ততক্ষনাত বাহিরে বের হয়ে দেখি ম্যানহাটনের ডাউনটাউনের পুরো আকাশ ধোঁয়ায় ধূসরিত।পথচারি তেমন কাউকেই পেলাম না পুরো ঘটনা জানার। ফোনে দু একজনকে পাওয়া গেল, কিন্তু কেউ কোন সঠিক জবাব দিতে পারলোনা। তখন আনমনেই টিভি পরদায় চোখ রাখা ছাড়া আর কোন উপায় ছিলনা।কখনও ফক্স নিউজ, কখনও সিএনএন এ রিমোট চালাচ্ছি।পরিশেষে যা বুঝা গেল, এটা ছিল একটা বিভৎস সন্ত্রাসী ঘটনা।এভাবেই ঘটেছিল নাইন ইলেভেনের ঘটনা। সেদিন সন্ত্রাসীরা চারটি বিমান ছিনতাই করে এই নিঃসংশ হত্যাকান্ড চালিয়েছিল। দুটি বিমান দিয়ে আঘাত করা হয় নিউইয়র্ক এর বিশ্ব বানিজ্য কেন্দ্র টুইনটাওয়ারে, একটি ওয়াসিংটনের পেন্টাগনে,আরেকটি পেনসলভেনিয়ার খোলা মাঠে বিধ্বস্ত হয়।আমেরিকায় সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী হামলায় চার বিমানের সব যাত্রী সহ প্রায় তিন হাজারের ও বেশী মানুষ নিহত হয়।আগুনের লেলিহান শিখা থেকে রক্ষা পেতে অনেকে বিল্ডিং এর জানালা দিয়ে নিচে ঝাপিয়ে পড়ে ব্যর্থ চেষ্টায় আত্মাহুতি দিল।আমি ও আমার মতো বিশ্বের কোটি মানুষ চেয়ে চেয়ে দেখলো এ বিবৎস দৃশ্য। এ বিধ্বংসী হামলায় পুরো বিশ্ব স্তম্ভিত হয়ে যায়। ঘটনাটি ছিল কল্পনার ও অতীত, এবং কি করে যে সবার অজান্তে এমন একটি ঘটনা ঘটে গেল কেউ তা জানতেই পারলোনা। কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। অনেক আগে থেকে নাকি প্রসাশনের কেউ কেউ আঁচ করতে পেরেছিলেন এমন একটি সন্ত্রাসী হামলা হতে পারে।সিআইএ,এফবিআই, এমনকি মার্কিন কংগ্রেস কমিশন সবাই এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন।২০০১ সালের পুরো গ্রীষ্মকাল জুড়েই এ সব সতর্ক বাণী চারিদিক থেকেই ভেসে আসছিল। এ নিয়ে দেশের বিখ্যাত চিন্তাবিদরা একটি কমিশন রিপোর্ট তৈরি করেছিলেন যে আগামীতে আমেরিকার উপর কি রকম নিরাপত্তা ঝুকি আসতে পারে।তার জন্য প্রায় আড়াই বছর সময় লেগেছিল রিপোর্টটি তৈরি করতে।এ জন্য কমিশন ২০ টি দেশের শতাধিক লোকের সাক্ষ্য গ্রহন করেছিল এবং এটাই ছিল দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর আমেরিকার নিরাপত্তার উপর সবচেয়ে বিশদ পর্যলোচনা। কমিশনের এগারো জন সদস্য সব তথ্য উপাত্তের বিশ্লেষণ করে উপলব্ধি করেন যে আমেরিকানরা একটা স্পষ্ট এবং বিদ্যমান ঝুকির সম্মুখীন। তবুও তারা মনে করে দেশের মাটিতেই মরবে তা যত বড় সংখ্যায়ই মৃত্যু আসুক। এই কমিশনটি গঠন করেছিলেন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন।২০০১ সালে যখন কমিশন রিপোর্ট টি বের হয় তখন হোয়াইট হাউসে নতুন প্রসিডেন্ট রিপাবলিকান জর্জ ডব্লিউ বুশ মাত্র এগারো দিন আগে দ্বায়িত্ব গ্রহন করেছেন। দ্বায়িত্ব পাবার সাথে সাথেই রিপোর্টটি প্রেসিডেন্টের হাতে তোলে দেওয়া হয়।কমিশনের ধারনা রিপোর্ট হাতে পেয়ে ও প্রেসিডেন্ট এ ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নেন নি। বুশ প্রশাসন পরে বলেছিল কোন সতর্ক বাণীর ভিত্তিতে কোন কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়া যুক্তিযুক্ত হতনা কারণ এতে নির্দিষ্ট কোনকিছু ছিলনা। পরে জানা যায় অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যের ফিনিক্সেরএক এফবিআই অফিসার ২০০১ সালের জুলাই মাসে একটা রিপোর্ট পাঠালেন যা এখন বিখ্যাত দলিল হিসেবে গন্য হচ্ছে। তিনি কিছু ঘটনা বর্ননা দিয়ে দাবী তুলেন এর তদন্ত করা হোক। কিন্তু এফবিআই এর কর্তা ব্যক্তিরা এ আবেদনের কার্যক্রম থামিয়ে দিলেন। তাদের ধারণাই ছিলনা যে এ ভাবে বিমান উড়িয়ে টুইনটাওয়ারে আঘাত হানতে পারে।তারা বিষয়টি ফু মেরে উড়িয়ে দিলেন। সিআইএর কাছে কিন্তু সতর্ক বার্তা ঠিকই বেজেছিল।তখন সিআইএর প্রধান ছিলেন জর্জ টেনেট। এগারো সেপ্টেম্বরের ঘটনার ১৪ বছর পরে সিবিএস টিভির সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেন,সেই গ্রীষ্মকালে তাদের কাছে এমন সব খবর আসতে থাকে যে তাতে বুঝা যায় আল কায়দা যে কোন সময় আমেরিকার উপর হামলা করতে পারে। কিন্তু বুশ প্রশাসনকে কিছুতেই বুঝানো সম্ভব হয়নি। তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কন্ডলিজা রাইস এর হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়।কন্ডোলিজা রাইস রাজি হলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট মিঃ চেনির সাথে আলাপ করতে। এর পাঁচ দিন পরেই আক্রমণ হলো। টুইনটাওয়ারে কর্মরত অবস্থায় তিন হাজার লোক প্রাণ হারালো। এর মধ্যে ডজন খানেক বাংলাদেশী প্রাণ হারান।দমকল বাহিনীর ৩৪৩ কর্মি ও হামলার দিন টুইনটাওয়ারে কর্মরত আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ৭১জন কর্মি প্রাণ হারিয়েছেন। পরবর্তীতে এ হামলার জন্য মুসলমান সম্প্রদায়ের উপর বর্তায়।মুসলমানরা চরম ক্ষোভের মুখে পরেন।দাড়ি টুপি ওয়ালা লোক কে ধর্ম বৈষম্যের শিকার হতে হয়।মুসলিম বিরোধী ঘৃণা ও প্রতি হিংসা এমন প্রকট হয়েছিল যে, লম্বা দাড়ি ও পাগড়ি ওয়ালা অনেক শিক ধর্মাবলম্বীদের হেইট ক্রাইমের শিকার হয়ে অনেককে প্রাণ দিতে হয়েছে। ২০০১ সালের পর হেইট ক্রাইম হামলার ঘটনা পাঁচ গুন বেড়ে যায়। মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টারে হামলা চলে নির্বিচারে।মুসলমান রাস্তাঘাটে প্রকাশ্য এমনকি গুপ্ত হত্যার শিকার হন। সেপ্টেম্বর ১১ এর পর আমেরিকা তথা সাড়া বিশ্বের রাজনৈতিক কার্যক্রম ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয়।জঙ্গীবাদ নির্মূলে নেমে পরে আমেরিকা,ইরাক,আফগানিস্থানে দখলের পর এখন পূর্ব পশ্চিমে জঙ্গী দমন নীতি অব্যাহত আছে এই ৯/১১ এর কারনে। বিন লাদেন অভিযুক্ত হলে তাকে হত্যা করে তার লাশ সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে।তার অনুসারীরা ছডিয়ে ছিটিয়ে আছে বিশ্বের সর্বত্র।জঙ্গীবাদের সাথে ধর্মীয় নাম যুক্ত হওয়ায় পশ্চিমা বিশ্বে মুসলমানরা হচ্ছেন লান্চিত। এরপরে ও ৯/১১ বাংলাদেশী আমেরিকানদের জন্য ছিল দুর্ভাগ্যজনক ও হৃদয়বিদারক দিন। এর শিকার হন বাংলাদেশী শাকিলা,তার স্বামী নুরুল হক মিয়া সহ বেশ কিছু নাম না জানা বাংলাদেশী রেষ্টুরেন্ট ওয়েটার থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশার কর্মজীবিরা। দীর্ঘদিন পরিশ্রমে ফসল “এক বিশ্ব বানিজ্য কেন্দ্র “ নামে ২০১৪ সালের ৩ নবেম্বর উদ্ভোধন করা হয়। আজও আকাশ ছুঁয়া এই উচ্চ ভবনের দিকে তাঁকালে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়,মনে হয় এখানে ও মিশে আছে আমাদের বাংলাদেশী ভাই বোনের রক্ত। তাই এদেশের সুখে দুঃখে হাসি কান্নায় আমাদের ও একাত্বতা প্রকাশ করা উচিত। ৯/১১ দিনটি আসলেই আমরা বাংলাদেশী আমেরিকান স্তব্ধ হয়ে যাই। আমরা ও বুকের মধ্যে রক্তক্ষরণ নিয়ে এই দিনটাকে স্বরণ করি।

লেখক: আবদুস শহীদ

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১৩
১৫১৬১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
৩০৩১