বুধবার, ২২শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

আবাসিক হোটেলের অন্তরালে সক্রিয় দেহব্যবসা

অভাব অনটনের কারনে কাজের খোঁজে গ্রাম থেকে রাজধানীতে এসেছিলেন স্বামী পরিত্যক্তা শিউলি বেগম। যাত্রাবাড়ী এলাকায় যেচে পরিচিত হন এক ব্যক্তি। তিনি চাকরির প্রলোভন দেখান। সরল বিশ্বাসে শিউলি লোকটির সঙ্গে যান। তারপর যাত্রাবাড়ীর শহীদ সরণি রোডের সামিউল্লাহ প্লাজায় অবস্থিত প্রভাতি আবাসিক হোটেলে শিউলির জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। দুই মাসের বেশি সময় ধরে শিউলিকে বদ্ধ কক্ষে জোর করে আটকে রেখে দেহ ব্যবসায় নামতে বাধ্য করা হয়। এখানেই শেষ নয়, কিছুদিন পর সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে শিউলিকে পাচার করে দেওয়া হয় ভারতে। পাচারের ছয় মাস পর পালিয়ে দেশে ফিরতে পেরেছেন শিউলি। কিন্তু আর স্বাভাবিক হতে পারেননি তিনি। সারাক্ষণ তাকে তাড়া করে ঢাকার যাত্রাবাড়ী ও ভারতের হায়দরাবাদে কাটানো বিভীষিকাময় জীবনের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। শিউলি জানান, ‘তিন বছর আগে স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয় আমার। এরপর দুই সন্তানকে নিয়ে অথই সাগরে পড়ি। দুই বেলা খাওয়াতেও পারতাম না। বাধ্য হয়ে চাকরির আশায় ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে চলে আসি। সেখানে এক লোকের সঙ্গে পরিচয় হয় আমার। তিনি আমাকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে একটি হোটেলে নিয়ে যান। কিন্তু সেখানে নেওয়ার পর আমার মোবাইল এবং অন্যান্য জিনিসপত্র কেড়ে নিয়ে আমাকে আটকে রাখা হয়। এক পর্যায়ে জোর করে দেহ ব্যবসায় নামতে বাধ্য করে আমাকে। এসব কাজ করতে রাজি না হলে নেমে আসত অসহনীয় অত্যাচার। পরে হোটেল মালিক শিশির ও সাজ্জাদ নামের দুই ব্যক্তি আমাকে ভারতে পাচার করে দেয়।’ শিউলি বলেন, ‘আমিসহ মোট আটজন নারীকে সাতক্ষীরা দিয়ে রাতের আঁধারে বর্ডার পার করে হায়দরাবাদে পাঠায় মানবপাচারকারীরা। সেখানে একটি বাড়িতে আটকে রাখা হয় আমাদের। ওই বাড়িতে আরো কয়েকজন তরুণীর সঙ্গে পরিচয় হয় আমাদের। তাদের মধ্যে কয়েকজন বাংলাদেশিও ছিল। আমাদের মতো তারাও দালালের মাধ্যমে পাচারের শিকার হয়। ওই বাড়িতে পাচারকারীচক্রের সদস্যদের কাছে কয়েকবার ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে। এর কয়েক দিন পরই আমাদের বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। হোটেলগুলোতে এক দিনে কয়েকজনের ধর্ষণের শিকার হতে হতো। এসব ঘটনার প্রতিবাদ করলে নেমে আসত ভয়ঙ্কর নির্যাতন। ওখানে যেহেতু আমাদের পাসপোর্ট ছিল না, পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে এবং ব্ল্যাকমেইল করে দেহ ব্যবসা চালিয়ে যেতে বাধ্য করা হতো।’
শিউলি বলেন, ‘এভাবেই কেটে যায় প্রায় ছয় মাস। যখন স্বাভাবিক জীবনে ফেরার স্বপ্ন বাদ দিয়েছি, তখনই দেখতে পাই আশার আলো। ভারতীয় এক খদ্দের আমাদের কষ্টের কথা শুনে সাহায্য করতে রাজি হন। পরে তার সহায়তায় আমরা আট নারী একইভাবে রাতের আঁধারে সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে চলে আসি। দেশে আসার পর এখনো আমরা ভয়ে পালিয়ে থাকি। যাত্রাবাড়ী এলাকার দিকে কখনোই আর আসি না।’ শুধু প্রভাতি আবাসিক হোটেলই নয়, যাত্রাবাড়ী এলাকার অনেক আবাসিক হোটেলই নারীপাচারের সঙ্গে জড়িত। সেগুলোর একটি শহীদ ফারুক রোডের চৌরাস্তায় হাজি ইউনুস মার্কেটের চতুর্থ তলার পপুলার আবাসিক হোটেল। এখানেও চাকরিপ্রার্থী অসহায় নারীদের জোর করে আটকে রাখার অভিযোগ রয়েছে। গত ২ জুন পপুলার হোটেলে অভিযান চালিয়ে দেহ ব্যবসার অভিযোগে কয়েকজন নারী ও পাচারকারীচক্রের কয়েকজন সদস্যকে আটক করে র‌্যাব। অভিযানে আটক মো. অলিউল্লাহ, মো. আকাশ খান ও মো. শরীফ হোসেন প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেন, তারা কাজের প্রলোভন দেখিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে নারীদের এনে জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করতেন। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত ১৫ বছরে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে শিউলির মতোই হাজারো অসহায় নারীকে দেহ ব্যবসায় বাধ্য করার পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশ ভারতে পাচার করেছে বিভিন্ন হোটেল কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি সরেজমিন হোটেল প্রভাতিতে এমন অপরাধের প্রমাণ মিলেছে। সাথি (ছদ্মনাম) নামের একজন নারী হোটেল ব্যবসার আড়ালে মালিকের নোংরা ব্যবসার ফাঁদের গল্প তুলে ধরেন। তিনি বারবার বলছিলেন, ‘আমাকে যেভাবেই হোক বের করার ব্যবস্থা করুন। আমি কাজের জন্য আসছিলাম। অফিশিয়াল কাজের কথা বলে নিয়ে এছে দেহ ব্যবসায় লাগাইছে। এর পেছনে শিশির ও সাজ্জাদ আছে। আরো অনেকেই আছে যাদের নাম জানি না। তারা জোর করে আমাকে দিয়ে নোংরা কাজ করায়। দীর্ঘদিন ধরে আমাকে এক রুমেই আটকে রাখা হয়েছে। কখনো বের হতে দেয় না। আমি মুক্তি চাই। আমি বের হতে চাই।’যাত্রাবাড়ী থানা সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের মে ও জুন মাসে একই ব্যক্তিদের মালিকানাধীন হোটেল প্রভাতি ও পপুলার আবাসিক হোটেলের বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। হোটেল মালিক শিশির চৌধুরীসহ মিশু, পলাশ মিয়া, আজিজুল, অলিউল্লাহ, জাকির হোসেন নামে কয়েক মানবপাচারকারীর বিরুদ্ধে মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে মামলা করা হয়। মামলার বিবরণে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে নারীদের আটকে রেখে জোরপূর্বক যৌন ব্যবসা করানোর বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। থানা সূত্র জানায়, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর নিয়মিত অভিযান ও মামলা হলেও আইনকে যেন তোয়াক্কাই করে না প্রভাবশালী চক্রটি। অন্যদিকে বিচারিক ব্যবস্থার ধীরগতির জন্য হোটেল কর্তৃপক্ষ ও মানবপাচারকারীচক্রটি যেন ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। পুরো বিষয়টি জানতে হোটেল মালিক ও মানবপাচারকারী সিন্ডিকেটের মূল হোতা শিশির চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

র‍্যাবের মিডিয়া ইউংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈনও বিষয়টি জানান, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এমন ঘটনার অভিযোগ পেলে নিজেরাই অভিযান চালায় র‌্যাব। এরই মধ্যে বেশ কিছু নারী পাচারকারীকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। বাকি চিহ্নিত পাচারকারীদেরও আইনের আওতায় নেওয়া হবে বলে জানান তিনি। অন্যদিকে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মুহাম্মদ সাইদুর রহমান খান জানান, চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন সময় মানবপাচারের ঘটনা ঘটছে। এমন অভিযোগ ও অপরাধের ঘটনা সম্পর্কে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী অবগত। এ বিষয়ে সিআইডি সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে যেন এ ধরনের অপরাধ অচিরেই কমে আসে।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০৩১

All Rights Reserved ©2024