
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ আগামী ২৭ ডিসেম্বর অবসরে যাচ্ছেন। সেক্ষেত্রে চলতি সপ্তাহেই নিয়োগ পেতে যাচ্ছেন দেশের ২৬তম প্রধান বিচারপতি। সংবিধানে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে একক ক্ষমতা দেওয়া রয়েছে। তবে জ্যেষ্ঠতা বিবেচনায় বিচারঙ্গনের প্রধানকে নিয়োগের রীতি রয়েছে। তবে সব সময় সেটি বিবেচনায়ও নেওয়া হয়নি। গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী সংস্কারে এই পদে নিয়োগের বিষয়ে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতির সুপারিশ করা হয়েছে।
জানা গেছে- প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ছাড়া বর্তমানে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে ৬ জন বিচারপতি রয়েছেন। জ্যেষ্ঠতা অনুসারে তারা হলেন- বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি মো. রেজাউল হক, বিচারপতি এসএম ইমদাদুল হক, বিচারপতি একেএম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি ফারাহ মাহবুব।
সংবিধানের অনুচ্ছেদে ৯৫ (১) এ উল্লেখ রয়েছে- ‘প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন এবং প্রধান বিচারপতির সহিত পরামর্শ করিয়া রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারককে নিয়োগদান করিবেন।’
এ ছাড়া চলমান অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে- বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা সমুন্নত রাখা এবং কার্যকরতা নিশ্চিত করা অনেকাংশে নির্ভর করে বিচার বিভাগের নেতৃত্বদানকারী ও শীর্ষব্যক্তি প্রধান বিচারপতির ওপর। বিদ্যমান সংবিধানের ৪৮ (৩) অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী বা অন্য কারও পরামর্শ ব্যতিরেকে রাষ্ট্রপতি নিজম্ব প্রজ্ঞা অনুসারে এককভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন। কিন্তু অতীতে বেশকিছু ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়ে নির্বাহী কর্তৃপক্ষ নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। ফলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা ও কার্যকরতা নানা সময়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
প্রধান বিচারপতির নিয়োগ প্রসঙ্গে সুপারিশে আরও উল্লেখ করা হয়েছে- কমিশন মনে করে যে, বিচার বিভাগের ওপর জনগণের আস্থা বজায় রাখার জন্য প্রধান বিচারপতির নিয়োগকে নির্বাহী কর্তৃপক্ষের প্রভাবমুক্ত রাখার লক্ষ্যে সংবিধানে এই মর্মে বিধান থাকা প্রয়োজন যে, রাষ্ট্রপতি আপীল বিভাগের কর্মে প্রবীণতম বিচারককেই প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করবেন। অর্থাৎ, প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগ বা অন্য কোনো বিকল্প পদ্ধতি রাখা যাবে না। এর ফলে প্রধান বিচারপতির নিয়োগে রাজনৈতিক বিবেচনা প্রয়োগের সুযোগ বহুলাংশে লোপ পাবে। সেই লক্ষ্যে সংবিধানের ৪৮ (৩), ৫৫ (২) এবং ৯৫ (১) অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে ।
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, জ্যেষ্ঠ বিচারপতির বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ থাকলে দ্বিতীয় জ্যেষ্ঠ বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি দেশপ্রেম, বিচার বিভাগের প্রতি দায়বদ্ধতা ও সততার বিষয়গুলোও বিবেচনা করতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, আশা করি চলতি সপ্তাহে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত হবে। অতীতে দেখেছে মেয়াদ শেষ হওয়ার হওয়ার কয়েকদিন আগে পরবর্তী প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়। তিনি আরও বলেন, নিয়োগের ক্ষেত্রে জেষ্ঠ্যতা একটি বিষয়। তবে পাশাপাশি তার সতত ও দেশপ্রেমসহ অতীতের বিচারিক কার্যক্রম বিবেচনায় নিতে হবে। তিনি জুলাই অভ্যুত্থান ধারণ করেন কিনা, সেই বিষয়টিও বিবেচনায় আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন এই সিনিয়ির আইনজীবী।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আপিল বিভাগের ছয় বিচারপতির মধ্যে পরবর্তী প্রধান বিচারপতি হিসেবে বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরীর নাম বেশি আলোচনায় রয়েছে।
দেশের ২৫তম প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ অবসরে যাচ্ছেন ২৭ ডিসেম্বর। ওই দিন সুপ্রিমকোর্টে অবকাশকালীন ছুটি থাকায় গত ১৮ ডিসেম্বর (ছুটির আগে শেষ কর্মদিবস) তাকে বিদায়ী সংবর্ধনা দিয়েছে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় ও সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতি। অধস্তন আদালতের বিচারকদের উদ্দেশে বিদায়ী অভিভাষণও দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। অভ্যুত্থানপরবর্তী প্রেক্ষাপটে প্রধান বিচারপতি নিয়োগে জ্যেষ্ঠতা রক্ষা নাকি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটবে, তা নিয়ে আলোচনা চলছে আইন অঙ্গনে।
বাংলাদেশের রীতি অনুযায়ী আপিল বিভাগের বিচারপতিদের মধ্য থেকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে। তবে বর্তমান বিচরপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নিয়োগে ঘটে ব্যতিক্রম। অভ্যুত্থানের পরে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নিয়োগ পাওয়া বিচারপতিদের পদত্যাগের দাবিতে ২০২৪ সালের ১০ আগষ্ট সুপ্রিমকোর্ট ঘেরাওয়ের করে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া সমন্বয়করা। ওই দিন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ আপিল বিভাগের ছয়জন বিচারপতি পদত্যাগে বাধ্য হন। সেদিনই আন্দোলনকারীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদকে দেশের ২৫তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। বিচার বিভাগের ইতিহাসে এ ঘটনাটি ছিল বিরল।
সংবিধান অনুযায়ী ৬৭ বছর পূর্ণ হলে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অবসরে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আগামী ২৭ ডিসেম্বর প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের ৬৭ বছর পূর্ণ হচ্ছে। তবে ১৯ ডিসেম্বর সুপ্রিমকোর্টের শীতকালীন অবকাশ শুরু হওয়ায় ১৮ ডিসেম্বরই প্রধান বিচারপতি হিসেবে শেষবারের মতো তিনি এজলাসে বসেন।