সোমবার, ২০শে মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

ট্রান্সজেন্ডার সম্পর্কে ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি

ট্রান্সজেন্ডার ইদানীং আলোচিত এক বিষয়। ট্রান্সজেন্ডারবাদ বা রূপান্তরকামীতা নামে একটি মতবাদ রয়েছে। অনেকে একে জেন্ডার আইডেন্টিটি বা লিঙ্গ পরিচয় মতবাদও বলে থাকেন। এই মতবাদ বলে- কোনো পুরুষের যদি ‘নিজেকে নারী বলে মনে হয়’ তাহলে সে একজন নারী। সমাজ ও আইন তাকে নারী হিসেবে বিবেচনা করবে, নারী হিসেবে সব অধিকার নিশ্চিত করবে। এমনকি সে দুই তিন বাচ্চার বাবা হলেও তাকে নারী হিসেবেই দেখতে হবে, এটা তার অধিকার।

একইভাবে কোনো নারীর যদি ‘নিজেকে পুরুষ মনে হয়’ তাহলে সে একজন পুরুষ। সমাজ ও আইন তাকে পুরুষ বিবেচনা করে সব অধিকার নিশ্চিত করবে। শারীরিকভাবে নারী হওয়া কিংবা কয়েক বাচ্চার মা হওয়াও ট্রান্সজেন্ডারবাদের ভ্রান্তির প্রমাণ নয়। বরং ট্রান্সজেন্ডারবাদের চোখে এটাই প্রমাণ করে যে, একজন পুরুষও সন্তান জন্ম দিতে পারে।এই মতবাদে বিশ্বাসীদের দাবী- মানুষ ইচ্ছেমতো পোশাক পরবে, ইচ্ছেমতো ওষুধ আর অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বদলে নেবে নিজের দেহকে। আর কেউ যদি অস্ত্রোপচার না করেই নিজেকে বিপরীত লিঙ্গের দাবী করে, তা-ও মেনে নিতে হবে। এটা তার অধিকার। ট্রান্সজেন্ডারবাদে বিশ্বাসীদের বিভিন্ন লেখায় দেখা যায়, কোনো ছেলের অনুভূতি যদি মেয়ের মতো হয় এবং তার যদি মেয়ে হয়ে বাঁচতে ইচ্ছে হয় তাহলে বুঝতে হবে শরীরটা আসলে তার নয়। বাংলাদেশে ট্রান্সজেন্ডারবাদ নিয়ে কাজ করা অ্যাক্টিভিস্টদের মধ্যে অন্যতম হো চিন মিন ইসলাম। ট্র্যান্সজেন্ডারবাদ প্রতিষ্ঠায় আইন তৈরির দাবিও জানিয়ে আসছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আমার শরীরটা পুরুষের ছিল, কিন্তু ছোটবেলা থেকেই আমি নিজেকে নারী ভাবতাম। অবশেষে অস্ত্রোপচার করে নারী হয়েছি, গোপন করার কিছু নেই। এখন আমি শারীরিক ও মানসিকভাবে একজন নারী।’

হো চিন মিন ইসলামের কথা থেকে এ বিষয়টি স্পষ্ট যে, ট্রান্সজেন্ডারবাদের সঙ্গে শারীরিক সমস্যার কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি লিঙ্গ পরিবর্তন অপারেশন করেছেন ২০২৩ সালে। কিন্তু এর তিন বছর আগে থেকেই সামাজিক ও আইনিভাবে তাকে এবং তার মতো অন্যদের নারী হিসেবে মেনে নেওয়ার দাবি করে আসছেন তিনি। অর্থাৎ অস্ত্রোপচার হোক বা না হোক, যখন থেকে কেউ নিজেকে বিপরীত লিঙ্গের বলে দাবি করা শুরু করবে, তখন থেকেই সামাজিক ও আইনিভাবে এ দাবি মেনে নিতে হবে।বিশ্বজুড়ে এই মতবাদের প্রচার-প্রসার চলছে। বিচিত্র এই মতাদর্শকে উপস্থাপন করা হচ্ছে নাগরিক ও মানবাধিকারের প্রশ্ন হিসেবে। প্রশ্ন হলো, একজন মুসলিম কি চাইলে লিঙ্গ রূপান্তর করতে পারে? অথবা পুরুষ শরীর নিয়ে নিজেকে নারী কিংবা নারী শরীর নিয়ে নিজেকে পুরুষ দাবি করতে পারে? কিংবা তাদের দাবি পূরণ করার অনুমতি আছে ইসলামে?

এর উত্তর হলো- না। মুসলমানের লিঙ্গ পরিবর্তনের অনুমতি নেই। পুরুষ শরীর নিয়ে নারী দাবি করা বা নারী শরীর নিয়ে নিজেকে পুরুষ দাবি করার অনুমতি কোরআন-হাদিসের কোথাও নেই। বরং বিপরীত লিঙ্গের সাজ-সজ্জাকেও কঠিনভাবে নিষেধ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি (আল্লাহ) মানুষকে সৃষ্টি করেছি সুন্দরতম গঠনে।’ (সুরা ত্বিন: ৪) হজরত আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল (স.) এমন সব নারীর ওপর অভিসম্পাত করেছেন, যারা অঙ্গে উল্কি আঁকে ও অন্যকে দিয়ে উল্কি আঁকায় এবং সৌন্দর্যের জন্য ভ্রুর চুল উপড়ে আল্লাহ তাআলার সৃষ্টিকে পরিবর্তন করে (তিরমিজি: ২৭৮২)পবিত্র কোরআনের এক আয়াতে মহান আল্লাহ তাঁর সৃষ্টির পরিবর্তন-পরিবর্ধনকে শয়তানের কাজ বলে আখ্যা দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘সে (শয়তান) বলে, আমি অবশ্যই তোমার বান্দাদের এক নির্দিষ্ট অংশকে আমার অনুসারী করে নেব। আমি তাদের পথভ্রষ্ট করবই; তাদের হৃদয়ে মিথ্যা বাসনার সৃষ্টি করব। আমি তাদের নিশ্চয়ই নির্দেশ দেব আর তারা পশুর কর্ণোচ্ছেদ করবেই এবং তাদের নিশ্চয়ই নির্দেশ দেব আর তারা আল্লাহর সৃষ্টি বিকৃত করবেই। (আল্লাহ বলেন) আল্লাহর পরিবর্তে কেউ শয়তানকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করলে সে স্পষ্টভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’ (সুরা নিসা: ১১৬-১১৯)

উপরুক্ত আয়াতে দেখা যাচ্ছে, অভিশপ্ত শয়তান মহান আল্লাহকে বলেছিল, ‘নিশ্চয়ই নির্দেশ দেব আর তারা আল্লাহর সৃষ্টি বিকৃত করবেই।’ বোঝা গেল অহেতুক নিজের শরীরে বিকৃত সৃষ্টি করা মহান আল্লাহর সৃষ্টি বিকৃত করার শামিল। সুতরাং ট্রান্সজেন্ডার ও ট্রান্সজেন্ডারবাদের দাবি পূরণ করা ইসলাম পরিপন্থী কাজ। ইসলামে স্বাভাবিক দেহাবয়বই মানুষের জন্য উৎকৃষ্ট নেয়ামত। সেই অনুযায়ী সামাজিক ও আইনিভাবে তার অধিকার বা উত্তরাধিকার নিশ্চিত হবে। অনেকে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সঙ্গে ট্রান্সজেন্ডারদকে গুলিয়ে ফেলেন। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের অধিকার নিশ্চিতে ইসলামে সুন্দর বিধান রয়েছে। ট্রান্সজেন্ডার কিন্তু তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ নয়। বরং তারা বিশেষ অস্ত্রোপচার ও হরমোন প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে রূপান্তরিত লিঙ্গের ব্যক্তি অথবা লিঙ্গ পরিবর্তন ছাড়াই মানসিক দিক থেকে সৃষ্টিগত লিঙ্গের চেয়ে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি বেশি আসক্ত ব্যক্তি।

পশ্চিমা অনেক দেশে ট্রান্সজেন্ডারবাদ মতাদর্শ বাস্তবায়নের ফলে সামাজিক, স্বাস্থ্য এবং আইনগত নানা সমস্যা গত কয়েক বছরে অনুধাবন করা যাচ্ছে। এটি হাজার হাজার বছরের প্রতিষ্ঠিত লিঙ্গভিত্তিক সিস্টেমকে ওলট-পালট করে দিচ্ছে, তৈরি হচ্ছে নানা বিতর্ক। এ মতবাদ সমাজের ভারসাম্যতা ও স্বাভাবিক রীতিকে ধ্বংসের মুখে ফেলে দিচ্ছে। উত্তরাধিকার সম্পত্তি বণ্টন নিয়ে তৈরি হচ্ছে মারাত্মক সামাজিক বিশৃঙ্খলা। গবেষণায় দেখা গেছে, সাধারণ মানুষের তুলনায় এদের মধ্যে ১৪ গুণ বেশি আত্মহত্যা চিন্তা এবং ২২ গুণ আত্মহত্যার আশংকা থাকে। আরও নানাধরণের সমস্যার কথা বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেবিশ্বের বিখ্যাত টেক বিলিওনিয়ার ইলন মাস্ক ট্রান্সজেন্ডার মতাদর্শের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নিয়েছেন। এই বিষয়ে তিনি মাঝে মাঝে সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট দিয়ে পিতামাতাকে সচেতন রাখেন। এই বিষয়টির ভয়াবহতা অনুধাবন করাতে সম্প্রতি তিনি একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি (what is a woman) শেয়ার করেন। এক সপ্তাহের মধ্যে বিশ্বের ১৭০ মিলিয়ন মানুষ ভিডিওটি দেখেছে। (কালবেলা: ১৫ নভেম্বর ২০২৩)

সামাজিক এবং ধর্মীয় মান অক্ষুণ্ণ রাখতে মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকা মহাদেশের দেশগুলো এলজিবিটির বিরুদ্ধে সক্রিয় অবস্থান নিয়েছে। এমনকি উগান্ডা পশ্চিমা ভিসা নিষেধাজ্ঞা, বিশ্বের ব্যাংকের ঋণ স্থগিত করার মতো অর্থনৈতিক ব্যাপারকেও উপেক্ষা করেছে।

পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোও ট্রান্সজেন্ডার মতাদর্শে বিরুদ্ধে অবস্থা নিয়েছে। জেন্ডার আইডেন্টিটি ইস্যুতে ইতালির সরকার পরিবর্তন হয়। সম্প্রতি হ্যাংগেরি ট্রান্সজেন্ডাদের লিগালাইজেশন বন্ধ ঘোষণা করেছে।

সব ধরনের সমস্যাকে সামনে রেখে রাষ্ট্রের উচিত, এ ধরনের মতবাদ যারা লালন করে, এ মতবাদ বিস্তারে যারা সক্রিয় ভূমিকায় আছে তাদের চিহ্নিত করা, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া। নতুবা অদূর ভবিষ্যতে এমনসব সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে যার সমাধান বের করা অসম্ভব হয়ে পড়বে।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, আসলে ইসলামে পুরুষলিঙ্গ ও স্ত্রীলিঙ্গ ছাড়া অন্যকোনো লিঙ্গ নেই। এমনকি তৃতীয় লিঙ্গ যাদের বলা হয়, তাদেরও পুরুষ বা স্ত্রী নির্ধারণ করা হয় কোন দিক দিয়ে সে প্রস্রাব করছে তার ভিত্তিতে। উদাহরণস্বরূপ কোনো ব্যক্তির প্রস্রাব যদি পুরুষাঙ্গ নিয়ে নির্গত হয় তাহলে সে পুরুষ এবং সে সমাজ ও আইনের চোখে পুরুষ হিসেবেই গণ্য হবে। সেজন্যই রাসূলুল্লাহ (স.) দৈহিক বৈশিষ্ট্য পুরুষের কাছাকাছি এমন ‘হিজড়াদের’ পুরুষ ও দৈহিক বৈশিষ্ট্য নারীদের কাছাকাছি এমন ‘হিজড়াদের’ নারী হিসেবে বিবেচনা করার নির্দেশ দিয়েছেন। (সুনানে বাইহাকি কুবরা: ১২৯৪)ছেন।তবে হ্যাঁ সৃষ্টিগতভাবে কিছু মানুষের এ সংক্রান্ত বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে। যেমন- কোনো ব্যক্তির প্রজননব্যবস্থা পুরুষের, অর্থাৎ তার দেহ শুক্রাণু উৎপাদনের জন্য তৈরি, কিন্তু যৌন বিকাশের ত্রুটির কারণে বাহ্যিকভাবে তার মধ্যে বিপরীত লিঙ্গের কিছু বৈশিষ্ট্য (যেমন স্তনের মতো অঙ্গ) আছে- এমন ক্ষেত্রে সেই ত্রুটি দূর করার জন্য শর্তসাপেক্ষে অস্ত্রোপচারের বৈধতা আধুনিক আলিমগণ দিয়েছেন। একই কথা নারীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যেমন অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় অনেক কন্যাশিশুর জন্মের সময় যোনিপথ বন্ধ থাকে, যা অপারেশনের মাধ্যমে ঠিক করা সম্ভব, এ ধরনের চিকিৎসা গ্রহণকে ইসলাম নিষিদ্ধ বলে না।

এ ধরনের অস্ত্রোপচার সীমিত পরিসরে জায়েজ এবং এর উদ্দেশ্য হলো- একজন মানুষের শরীরকে তার দেহের প্রজননন ব্যবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা। বিকলাঙ্গতা দূর করা। ট্র্যান্সজেন্ডারবাদের লিঙ্গ পরিবর্তন সার্জারি সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। শারীরিকভাবে সুস্থ মানুষের ‘লিঙ্গ পরিবর্তন’ জাতীয় কোনো অস্ত্রোপচার ইসলামি শরিয়তে বৈধ না।

রাসুলুল্লাহ (স.) পুরুষদের মধ্যে নারীর বেশ ধারণকারীদের এবং নারীদের মধ্যে পুরুষের বেশ ধারণকারিণীদের অভিশাপ দিয়েছেন। (সহিহ বুখারি, মেশকাত: ৪৪২৯) রাসুলুল্লাহ (স.) আরো বলেছেন, আল্লাহ সেসব মানুষদের উপর অভিসম্পাত করেছেন যারা তাঁর সৃষ্টিতে বিকৃতি আনে। (বুখারি: ৪৮৮৬)

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে এই ঘৃণ্য কাজ ও প্রচারণা থেকে থেকে দূরে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০৩১

All Rights Reserved ©2024