বর্তমানে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে নানা নকশা ও আকারের বিভিন্ন ধরনের ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলাচল করছে। যত্রতত্র তৈরি হচ্ছে আর যে কেউ তার চালকের আসনে বসে নেমে পড়ছেন রাস্তায়। এভাবে দ্রুতগতির এই অবৈধ বাহন মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। এতে দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) করা নকশায় স্ট্যান্ডার্ড মডেলের অনুমোদিত ব্যাটারি রিকশা (ই-রিকশা) নামানো হচ্ছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় নতুন মডেলের এ রিকশার অনুমোদন দেবে। চালকের জন্য থাকবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। বিদ্যমান আইন সংশোধন করে এগুলো আনা হবে নিয়মের মধ্যে। বর্তমান বাণিজ্যিক ব্যাটারি রিকশা উচ্ছেদ করে সেখানে চলবে নিয়ন্ত্রিত নতুন রিকশা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের একটি দল নতুন ব্যাটারি রিকশার নকশা করেছে। সেটি অনুমোদন দিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এজন্য প্রচলিত স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন-২০০৯ সংশোধন করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এতে রিকশাচালকদের প্রশিক্ষণ, রিকশার কাঠামো এবং আইন ও জরিমানার বিষয়ে উল্লেখ থাকবে। এর মাধ্যমে এই বাহনকে নিয়ম ও কাঠামোর মধ্যে আনা হবে। শিগগিরই এ সংক্রান্ত একটি খসড়া উপদেষ্টা পরিষদে পাঠানো হবে। সেজন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে চাইলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের নগর উন্নয়ন অনুবিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, ব্যাটারি রিকশা নিয়ম ও কাঠামোর মধ্যে আনতে নিবন্ধন ও লাইসেন্সের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এজন্য বর্তমান আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এর অধীনে নতুন বিধি করা হবে। তাতে রিকশার কাঠামো, রিকশাচালকের প্রশিক্ষণ ও জরিমানার কথা উল্লেখ থাকবে।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বলছে, বর্তমান আইনে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন প্যাডেল রিকশার নিবন্ধন ও লাইসেন্স দেয় আর মোটরযানের নিবন্ধন দেয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। এখন মোটর ও ব্যাটারিচালিত রিকশার নিবন্ধন ও লাইসেন্স যাতে সিটি করপোরেশন দিতে পারে, সেজন্য বিদ্যমান আইনটি সংশোধন করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সড়কে চলাচল করা ব্যাটারি রিকশাগুলো ধীরে ধীরে উচ্ছেদ হবে। এর বিপরীতে নতুন মডেলের ব্যাটারি রিকশা নামানো হবে। এ প্রক্রিয়া ঢাকার দুই সিটি দিয়ে শুরু হবে। পর্যায়ক্রমে সারা দেশে করা হবে। নতুন রিকশার লাইসেন্স, নম্বর প্লেট ও অনুমোদন এবং রিকশা তৈরির জন্য কারখানাকেও অনুমোদন দেবে স্থানীয় সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া চালকের প্রশিক্ষণ ও পাসের পর একজন একটি করে গাড়ি নামানোর অনুমতি পাবেন। সিটির পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন এটি নিশ্চিত করবে। সংশ্লিষ্ট জেলা বা উপজেলার রাস্তা, জনসংখ্যা ও চাহিদার দিকটি বিবেচনা করে এটি নিয়ন্ত্রণ করা হবে। আবার এক শহরের রিকশা অন্য শহরে চালানো যাবে না, সেভাবে রঙ, নাম্বার আলাদা করা হবে। রিকশা বানানোর ক্ষেত্রে চালকরা এক বছর সময় পাবেন। বাংলাদেশ ব্যাংক ও মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) ঋণ দেবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, সুনির্দিষ্ট নকশার ভিত্তিতে এ রিকশা নামানো হবে। ইতোমধ্যে এটি প্রাইভেট সেক্টরকে দেওয়া হয়েছে। তারা এখন এটি বানাবে। দুয়েকজন এরই মধ্যে বানিয়েছেন। সেটি আমরা দেখব ঠিক আছে কি না। ঠিক থাকলে চালকের প্রশিক্ষণ শুরু করে দেব। যারা পাস করবেন তারা স্টিয়ারিংয়ে বসতে পারবেন।
তিনি বলেন, প্রশিক্ষণে পাস করা চালকদের একটি এনআইডি কার্ডের বিপরীতে একটি করে রিকশার লাইসেন্স দেওয়া হবে। কেউ একটির বেশি পাবেন না। রিকশা দিয়ে ব্যবসা করা যাবে না। অন্যদিকে নির্দিষ্ট নকশায় রিকশা তৈরি করতে পারবে কি না, নির্ধারিত মূল্যে সময়মতো রিকশা ডেলিভারি দিতে পারবে কি না, সেটিও লক্ষ্য রাখা হবে। অন্যদিকে এখনকার ব্যাটারি রিকশাগুলো প্রতিনিয়ত উচ্ছেদ করা হবে। প্রক্রিয়াটি সমান্তরালভাবে চলবে। ঢাকার দুই সিটিতে এ ধরনের রিকশা কয়েক লাখ নামবে।
এদিকে, গতকাল গুলশানে ডিএনসিসি নগর ভবনে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ‘ব্যাটারিচালিত রিকশার স্ট্যান্ডার্ড মডেল ও প্রোটোটাইপ নির্মাণের বিষয়ে হালনাগাদ অগ্রগতি এবং ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারণ’ শীর্ষক সভা হয়। এতে এ সিটির প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ঢাকার মূল সড়কে কোনো ব্যাটারিচালিত রিকশা চলতে পারবে না। শহরের অভ্যন্তরের সড়কে চলবে ই-রিকশা। এর স্ট্যান্ডার্ড মডেল ও নীতিমালা প্রস্তুতের জন্য অল্প সময়ের মধ্যে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা হবে।
বুয়েটের বিইপিআরসি ইজিবাইক প্রজেক্ট নতুন স্ট্যান্ডারাইজ মডেলের তিন চাকার স্বল্পগতিতে ই-রিকশার টাইপ-অনুমোদন ও রেজিস্ট্রেশন প্রস্তাবনা প্রণয়ন করে। প্রস্তাবনা অনুযায়ী প্রোটোটাইপ প্রস্তুত করতে প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে আহ্বান জানানো হয়। নতুন ব্যাটারি রিকশা রাস্তায় চলাচলকারী ইজিবাইকের মতো জানিয়ে বুয়েটের নকশাকারকরা জানান, রিকশায় ১৬টি বৈশিষ্ট্য যোগ করেছেন তারা। সেই সঙ্গে তারা এখন দেশে প্রচলিত ১২ ধরনের ব্যাটারিচালিত রিকশার নিরাপত্তা ত্রুটিগুলো খুঁজে বের করেছেন।
সভায় উপস্থিত ছিলেন ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবু সাঈদ মো. কামরুজ্জামান, প্রধান প্রকৌশলী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মঈন উদ্দিন, ডিএনসিসির মহাব্যবস্থাপক (পরিবহন) আব্দুল্লাহ আল মাসুদসহ ব্যাটারিচালিত রিকশা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিরা।
এর আগে গত ১৭ এপ্রিল নগর ভবনে অংশীজনদের নিয়ে স্থানীয় সরকার সচিব রেজাউল মাকছুদ জাহেদীর সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রতিনিধিরা অংশ নেন ওই সভায়।
সভা সূত্র জানায়, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ব্যাটারি রিকশা ও চালকদের তথ্য সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত হয়। রিকশার সংখ্যা, চালকের নাম, পরিচয়পত্র ও মোবাইল নম্বরের তথ্য সংগ্রহ করবে দুই সিটি ও বিদ্যুৎ বিভাগ। এক্ষেত্রে ঢাকার দুই সিটির পাশাপাশি এটুআই, বিদ্যুৎ বিভাগ, বিআরটিএ এবং জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন দপ্তরের প্রতিনিধিরা একটি সমন্বিত ফরম তৈরি করবেন।