নিজস্ব ডেস্কঃ চার মাস বয়সী শিশু তানজীম উমায়ের। জন্মগতভাবে হৃদযন্ত্রে ছিদ্র ছিল তার। রাজধানীর মিরপুরে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটে নিয়মিত চিকিৎসা চলছিল শিশুটির। যেকোনো শব্দেই প্রচণ্ড ভয় পেত উমায়ের। এজন্য বাসায় সবাই সতর্কতার সঙ্গে কথা বলতেন কিংবা জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করতেন।
গত থার্টি ফার্স্টে মধ্যরাতে টানা আতশবাজির বিকট শব্দে ভয় পেয়ে বারবার কেঁপে উঠছিল শিশুটি। এরমধ্যে শুরু হয় শ্বাসকষ্টও। কোনোমতে রাত পার করে পরদিন তাকে ভর্তি করা হয় হার্ট ফাউন্ডেশনে। সেখান থেকে প্রথমে আইসিইউ, পরে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হলেও সব চেষ্টা ব্যর্থ করে সবাইকে কাঁদিয়ে চলে যায় শিশু উমায়ের।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, হার্টফেলে মৃত্যু হয়েছে শিশুটির। আতশবাজির বিকট শব্দের কারণেই তার হার্টফেল হয়েছে কি-না তা জানা যায়নি। তবে সেই বিকট শব্দে শিশুটির বারবার কাঁপতে থাকার মুহূর্ত কিছুতেই ভুলতে পারছেন না বাবা-মা।
শনিবার (০১ জানুয়ারি) সকালে শ্বাসকষ্টসহ শিশু উমায়েরকে হাসপাতালে নিয়ে যান বাবা-মা। সন্ধ্যায় চিকিৎসক জানান শিশুটি আর বেঁচে নেই। ছেলে হৃদরোগে আক্রান্ত হলেও মনকে সান্ত্বনা দিতে পারছেন না বাবা-মা। বারবার মনে করছেন সেই থার্টি ফার্স্ট নাইটের কথা।
সোমবার (০৩ জানুয়ারি) বিকেল থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরছে ছোট্ট উমায়ের ও তার বাবার ছবি। চলছে পটকা-আতশবাজি ফাটানো নিয়ে নানা সমালোচনা, উঠছে নিষিদ্ধের দাবি। উমায়েরের বাবা ইউসুফ রায়হান বলেন, ‘আতশবাজির বিকট শব্দে ছেলেটা বারবার কেঁপে উঠছিল। তার সামনে গেলেই ভয়ে আঁতকে উঠছিল, দূরে সরে যাচ্ছিল। সারা রাত আতঙ্কে কাটে তার, শ্বাসকষ্টও হচ্ছিল। বিকট শব্দের এক পর্যায়ে আমি ও আমার স্ত্রী আমাদের ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরি। তার বুকে মাথা রাখি। ছেলেটা তখনো স্বাভাবিক হচ্ছিল না। কে জানতো, পরের দিনই আমাদের ছেড়ে যাবে। ’
তিনি বলেন, ‘আমার বাবু মায়ের পেট থেকেই হৃদযন্ত্রে ছিদ্র নিয়ে এসেছিল। প্রথমে রোগ ধরতে না পারলেও আমরা বিভিন্ন হাসপাতালে তার টেস্ট করাই। অবশেষে রোগ শনাক্ত করতে পেরে চিকিৎসকরা ফেব্রুয়ারিতে তার অপারেশনের ডেট দেন। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার (৩০ জানুয়ারি) তাকে ডাক্তার দেখানোর কথা ছিল। ডাক্তারের একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজের কারণে তাকে দেখানো যায়নি। ডাক্তার উমায়েরকে শনিবার (০১ জানুয়ারি) নিয়ে যেতে বলেছিলেন।
‘থার্টি ফার্স্ট নাইটে কী ঘটেছিল—জানতে চাইলে ইউসুফ রায়হান বলেন, ‘শুক্রবার রাতে উমায়ের বেশ সুস্থ ও প্রাণবন্ত ছিল। সন্ধ্যার দিকে মনের আনন্দে খেলাধুলা করছিল। সন্ধ্যায় তার মা আমাকে ভিডিও কল করে ছেলেটাকে দেখালো। উৎফুল্ল ছেলেকে দেখে আমিও বাসায় ফিরে আসি। বাসায় ফিরে দেখি উমায়েরের মা তাকে খাওয়াচ্ছে। ’
‘রাত ১১টা ৪০ মিনিটের দিকে বিকট শব্দে পটকা ও আতশবাজি ফাটানো শুরু হলো। ১২টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশ থেকে পটকা ফাটানোর অনেক শব্দ হচ্ছিল। ছেলেটা তখন রীতিমত কাঁপছিল। আমি যখন তাকে চুমু খেতে যাচ্ছিলাম, তখনো সে ভয় পাচ্ছিল, কান্নাকাটি করছিল। ’
তিনি বলেন, ‘আমি তখন উমায়েরের মাকে বলি ওকে জড়িয়ে ধরতে, যাতে বিকট শব্দ তার কানে না যায়। আমরা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরি। বুঝতে পারছিলাম শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল তার। কোনোভাবে রাতটি পার করলাম। সকালে শ্বাসকষ্ট বেশি হওয়ায় আমরা তাকে হার্ট ফাউন্ডেশনে নিয়ে যাই। চিকিৎসক তাকে সঙ্গে সঙ্গে ভর্তি নেন। দুপুর পর্যন্ত তার অবস্থা খুব খারাপ ছিল, বিকেলে তাকে আইসিইউতে নেওয়া হলো। এর পরপরই নেওয়া হলো লাইফ সাপোর্টে। সন্ধ্যায় কিছুক্ষণ পর ডাক্তার আমাদের ডেকে বললেন ছেলেটা হার্টফেল করেছে, সে আর বেঁচে নেই। ‘
ইউসুফ বলেন, ‘সত্যিই বিকট শব্দের কারণে উমায়েরের হার্টফেল হয়েছে কি-না, আমরা তা বলতে পারব না। তবে সেই বিকট শব্দের কারণে বারবার কাঁপতে থাকা ছেলেটির সেই মুহূর্তের চেহারা কিছুতেই ভুলতে পারছি না। শুধু মনে হচ্ছে, আতশবাজির শব্দে আমার বাচ্চাটার অনেক কষ্ট হয়েছে, আমরা তার কষ্ট কমাতে পারিনি। আমরা কাউকে বলতে পারিনি, ভাই আপনারা বাজি ফোটাবেন না, আমার বাবুটা কষ্ট পাচ্ছে। ’