প্রকাশের তারিখঃ নভেম্বর ২৫, ২০২৩, ৫:১১ অপরাহ্ণ
ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই

বিশ্বাস ও বিজ্ঞান, এই দুইয়ের মধ্যে একটা চিরশত্রুতা তৈরি করে রেখেছি আমরা। বিজ্ঞানমনস্কদের একটি দল বিশ্বাসীদের দিকে আঙুল তুলে অন্ধ, মূর্খ ইত্যাদি বলেন। বিশ্বাসীদেরও একটি দল আছে, তারাও ছেড়ে কথা বলেন না। তারা বলেন, ওরা নাস্তিক, কাফের ইত্যাদি। এই দুই শ্রেণিই বিশ্বাস ও বিজ্ঞান বিষয়ে ভাসা ভাসা জানেন কিংবা কোনো একটি সাম্প্রদায়িক স্বার্থ সিদ্ধির জন্য জেনে বা না জেনে পরস্পরের বিরোধিতা করেন।
প্রকৃতপক্ষে বিশ্বাস ও বিজ্ঞানের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। ড. মরিস বুকাইলি কোরান ও বাইবেলের আলোকে বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় ব্যাখ্যা করে এই দূরত্ব ঘোচাবার চেষ্টা করেছেন। আরো অনেকেই এই চেষ্টা করেছেন। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছেন, ধর্ম ছাড়া বিজ্ঞান খোড়া, বিজ্ঞান ছাড়া ধর্ম অন্ধ। আমরা নিশ্চয়ই খোড়া বিজ্ঞান আর অন্ধ ধর্ম চাই না। সুস্থ বিজ্ঞান এবং সুস্থ ধর্ম চাইলে আমাদের উচিত হবে বিজ্ঞান ও ধর্ম বা বিশ্বাস দু’টোকেই ভালো করে জানা।
বিজ্ঞান ও বিশ্বাস হচ্ছে দিন ও রাতের মত। বিজ্ঞান হলো দিন, বিশ্বাস হলো রাত। ধরুন আপনি একটি অরণ্যে দাঁড়িয়ে আছেন। দিনের আলোতে গাছ দেখেন, পাখি দেখেন, লেক দেখেন, বন্য-প্রাণী দেখেন। এটাই বিজ্ঞান। যা আছে তা স্পস্ট দেখতে পাওয়া এবং যা নেই তা দেখতে না পাওয়া। যখন রাত নেমে আসে তখন আপনি কিছুই দেখেন না কিন্তু আপনি বিশ্বাস করেন এখানে গাছ আছে, পাখি আছে, লেক আছে, বন্য-প্রাণী আছে। কখনো কখনো অন্ধকারে আপনার কল্পনা আরো দূরে বিস্তৃত হয়। ওই দূরে, পাহাড়ের ওপারে কি আছে তাও কল্পনা করতে পারেন যা আপনি দিনের আলোতে দেখতে পান না। কিন্তু আপনি যদি আবার হেঁটে গিয়ে পাহাড় অতিক্রম করেন তখন ওপারের লোকালয়, প্রকৃতি ইত্যাদি দেখতে পান। এই যে না দেখেও জানেন বা কল্পনা করেন নানান কিছুর অস্তিত্ব এটিই ধর্ম বা বিশ্বাস। বিশ্বাস একটি বিশাল অন্ধকার চাদরের নিচে বিজ্ঞানকে লুকিয়ে রাখে মাত্র। একটু একটু করে বিশ্বাসের চাদর উন্মোচিত হলেই বেরিয়ে আসে বিজ্ঞান। প্রকৃতপক্ষে বিশ্বাস এক মহাসমুদ্র, বিজ্ঞান সেই সমুদ্রের এক ফোটা জল। একদিন হয়ত পুরো সমুদ্রটাই বিজ্ঞান হয়ে উঠবে, আবার তা নাও হতে পারে।
রাতে আমরা অনেক কিছুই দেখি না। তাই বলে কি আমরা অনন্ত দিন চাইব? বরং আমরা রাতের অন্ধকার দূর করার জন্য বিজ্ঞানের আলো জ্বালবো, কিন্তু আমাদের রাতও লাগবে, দিনও লাগবে। রাত না থাকলে দিনের গুরুত্ব যেমন বুঝবো না তেমনি দিন না থাকলে রাত মূল্যহীন হয়ে পড়বে। এটিই আইনস্টাইন বলেছেন, ধর্ম ছাড়া বিজ্ঞান অসম্পূর্ণ আবার বিজ্ঞান ছাড়া ধর্ম অসম্পূর্ণ। এজন্যই তিনি জ্ঞানের চেয়ে কল্পনাকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। জ্ঞান হচ্ছে সেই সত্য যা আবিস্কৃত, প্রমাণিত; অর্থাৎ বিজ্ঞান। কল্পনা হচ্ছে এমন কিছু যা আছে বলে অনুমান করছি কিন্তু আমরা কেউ নিশ্চিত নই অর্থাৎ এর অস্তিত্ব প্রমাণিত নয়, এটিই বিশ্বাস বা ধর্ম। মানুষের যদি কল্পনা করার এই ক্ষমতা না থাকতো তাহলে কোনো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার সম্ভব হতো না। অন্য সকল প্রাণির চেয়ে মানুষ উত্তম, একথা ধর্ম বলেছে, বিজ্ঞান তা প্রমাণ করেছে। কেন মানুষ শ্রেষ্ঠ? কারণ কেবল মানুষই কল্পনা করতে পারে, অন্য কোনো প্রাণি কল্পনা করতে পারে না।
খুব সহজ কিছু দৃষ্টান্ত দিই। এই তো সেদিন, ১৯০১ সালে, উড়োজাহাজ আবিস্কার হয়েছে। আজ থেকে দুশ, তিনশ বছর আগে কেউ যদি বলত মানুষ আকাশে উড়ছে, ধর্মে বর্ণিত এরকম কথাকে পাগলের প্রলাপ বলত নিশ্চয়ই বিজ্ঞানমনস্করা। দুই হাজার বছর আগে রচিত রামায়নে রাবনের পুষ্পক রথ অর্থাৎ বিমানের কথা লেখা আছে। দুই হাজার বছর ধরে এটি ছিল আজগুবি কল্পনা কিন্তু এই আজগুবি কল্পনা আজ বিজ্ঞান। একশ বছর আগে কেউ যদি বলত পৃথিবীর দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে দুজন মানুষ পরস্পরকে দেখতে পাবে, কথা বলতে পারবে কোনো রকম তারের সংযোগ ছাড়া। এটা নিশ্চয়ই এক আজগুবি কল্পনা হিসেবেই বিবেচিত হত। অথচ আজ তা বিজ্ঞান।
বিশ্বাসীরা বা ধর্মানুসারীরা বা কল্পনাকারীরা যা বলেন, তা-ই বিজ্ঞানকে পথ দেখায়। সুতরাং বিশ্বাস বা ধর্ম হচ্ছে বিজ্ঞানের পথপ্রদর্শক। এজন্যই কি আইনস্টাইন বলেননি ধর্মহীন বিজ্ঞান খোড়া, সে সামনে এগিয়েই যেতে পারবে না। একইভাবে বিশ্বাসীদেরও প্রতিটি বিশ্বাসকে বিজ্ঞানের আলোকে চিন্তা করার চেষ্টা করতে হবে। বিজ্ঞানই ধর্মকে দৃষ্টি দেবে, ধর্মকে সত্য করে তুলবে।
যেভাবে একের পর এক নতুন আবিস্কারের মধ্য দিয়ে ধর্মের গা থেকে অন্ধকারের চাদর সরিয়ে সত্যকে বের করে আনছে বিজ্ঞান।
Copyright © 2025 Michigan Pratidin. All rights reserved. | Developed by UNIK BD