শনিবার, ৪ঠা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

নতুন রূপে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক মধুর ক্যান্টিন

৩০-এর দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র ছিলেন কবি বুদ্ধদেব বসু। তিনি মধুর ক্যান্টিন নিয়ে স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন: ‘বিশ্ববিদ্যালয় কম্পাউন্ডের এক প্রান্তে টিনের চালওয়ালা দর্মার ঘর, ভেতরে মলিনবর্ণ টেবিলের পাশে লম্বা ন্যাড়া টুল পাতা। এখানেই আমরা ক্ষুৎপিপাসা নিবারণ করে থাকি, যেহেতু সারা তল্লাটে দ্বিতীয় কোনো চা-ঘর নেই। আদিত্যর ভোজ্যতালিকা অতি সীমিত, কোনো দিন তাঁর স্বহস্তে প্রস্তুত মিষ্টান্ন ছাড়া আর কিছুই দিতে পারে না আমাদের।’

ইতিহাস-ঐতিহ্যমণ্ডিত মধুর ক্যান্টিন পুনঃসংস্কারের পর ফিরে এসেছে নতুন রূপে। ঠিক বেশি কিছুই না, অল্প একটু রঙের প্রলেপ, সিমেন্ট দিয়ে কিছুটা প্লাস্টারের কাজ। এতেই মধুর ক্যান্টিন হয়ে উঠেছে দারুণ চাকচিক্যময়। কে বলবে এ ভবন এতটা পুরোনো! তবে পুরাতনের ছোঁয়াকে পুরোপুরি মুছে ফেলবার চেষ্টা করা হয়নি। এ যেন মধুর ক্যান্টিনের নবরূপায়ণ, পুরোনোর মধ্যে নতুনের আভা। গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে এ বছরের জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত চলে এটির সংস্কার কাজ।

মধুর ক্যান্টিনের পুনঃসংস্কারের ব্যাপারে কথা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে। দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান জানালেন, মধুর ক্যান্টিনে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতেই বহু ছাত্র আন্দোলনের ছক কষা হয়েছে। ‘দীর্ঘকাল সংস্কারবিহীন অবস্থায় থাকা এ ঐতিহাসিক ক্যান্টিনটির পুনঃসংস্কার খুবই ভালো উদ্যোগ। নতুন রঙে রাঙানো মধুর ক্যান্টিনের পাশ দিয়ে হাঁটতেও অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করে,’ বলেন তিনি।

আদিত্য রেস্তোরাঁ থেকে মধুর ক্যান্টিন

মধুর ক্যান্টিনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আদিত্যচন্দ্র। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আদিত্যচন্দ্র এখানে ব্যবসা শুরু করেন। তৎকালীন কলাভবন ছিল বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ এলাকায়। আশপাশ জুড়ে ছিল ব্রিটিশ পুলিশ ছাউনি। ব্রিটিশ সরকার ক্যাম্পাস থেকে পুলিশ ছাউনি গুটিয়ে নিতে শুরু করে। আদিত্যচন্দ্র ব্রিটিশদের থেকে ছনের দুটি ঘর কিনে নেন। একটিতে তিনি থাকতেন, আরেকটিতে বিক্রি করতেন চা সিঙ্গারা। এভাবেই আদিত্য রেস্তোরাঁর পথচলা শুরু।

৩০-এর দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র ছিলেন কবি বুদ্ধদেব বসু। তিনি মধুর ক্যান্টিন নিয়ে স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন: ‘বিশ্ববিদ্যালয় কম্পাউন্ডের এক প্রান্তে টিনের চালওয়ালা দর্মার ঘর, ভেতরে মলিনবর্ণ টেবিলের পাশে লম্বা ন্যাড়া টুল পাতা। এখানেই আমরা ক্ষুৎপিপাসা নিবারণ করে থাকি, যেহেতু সারা তল্লাটে দ্বিতীয় কোনো চা-ঘর নেই। আদিত্যর ভোজ্যতালিকা অতি সীমিত, কোনো দিন তাঁর স্বহস্তে প্রস্তুত মিষ্টান্ন ছাড়া আর কিছুই দিতে পারে না আমাদের।’

১৯৩৯ সালে আদিত্যচন্দ্র মারা যান। এরপর তার ১৯ বছর বয়সি ছেলে মধুসূদন দে ব্যবসার হাল ধরেন। প্রথমদিকে ছনঘরেই ব্যবসার কাজ চালাচ্ছিলেন মধুসূদন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী সময়ে আসেন বর্তমান ভবনটিতে। একসময়ে এটি ছিল নবাবের মনোরঞ্জনের জন্যে বাইজিদের নাচঘর। একতলা ভবনটি ১৯০৪ সাল পর্যন্ত দরবার হল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। শুধু বাংলাদেশ নয়, পাকিস্তানের জন্ম যে মুসলিম লীগের হাত ধরে, তারও নাড়ির যোগ আছে এই মধুর ক্যান্টিনের সাথে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের জন্য ওই সময়টাতে একটি ক্যান্টিনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিল। তাই এ জায়গাটি মধুসূদন দেকে ক্যান্টিন পরিচালনার জন্যে দেওয়া হলো।

মধুসূদন দে হলেন সকলের প্রিয় মধুদা

মধুসূদন দের সততা আর আন্তরিক ব্যবহারের জন্যে অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি শিক্ষার্থীদের খুব কাছের হয়ে উঠলেন। মধুসূদন দে থেকে হয়ে উঠলেন সকলের প্রিয় মধুদা। পরম বিশ্বস্ত মধুদার ক্যান্টিন হতে শুরু করলো ছাত্র রাজনীতির পূণ্যস্থান — চায়ের কাপে তুমুল তর্ক-বিতর্ক আর আড্ডার ফোয়ারা উঠল। যে ক্যান্টিনে খাবারের আতিশয্য নেই কিন্তু রয়েছে যুক্তিতর্কের ঝড়, বহু মতের মানুষের সম্মেলন। মধুর ক্যান্টিনে যে বাকির খাতা ছিল, সেটির নাম ছিল ‘না দিয়ে উধাও’। শিক্ষার্থীদের পকেটে তাৎক্ষণিকভাবে টাকা না থাকলে লিখে যেতেন মধুদার খাতায়। অনেকেরই হয়তো পরিশোধ করা হয়নি কাপের পর কাপ চায়ের বিল। এ নিয়ে কোনো অভিযোগ ছিল না মধুদার।

আটচল্লিশের ভাষা আন্দোলন, ঊনপঞ্চাশের বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলন, বায়ান্নর রক্তঝরা দিন, ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনী যুদ্ধ, ষাটের দশকে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন, ৬৬’র ছয়দফা, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭০’র নির্বাচন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন — বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে মধুর ক্যান্টিন জড়িয়ে রয়েছে ওতপ্রোতভাবে।

২৫ মার্চের কালরাত: মধুদাকেও ছাড়েনি তারা

২৫ মার্চের কালরাতে ঢাকা জুড়ে চলেছিল হত্যাযজ্ঞ। বাঁচতে পারেননি মধুদাও। মধুদার পরিবার থাকতেন জগন্নাথ হলের পাশে শহীদ মিনারের দিকে যেতে প্রধান সড়কসংলগ্ন ৩ নং বিল্ডিংয়ে। ২৫ মার্চ শেষ রাতে পাকবাহিনীর একটি দল মধুদার খোঁজে আসে। তাদেরকে পথ দেখিয়ে এনেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই কোনো এক চতুর্থ শ্রেণির স্টাফ। তাদের ডাকাডাকিতে দরজার খোলার পরই নৃশংসভাবে মেরে ফেলা হয় মধুসূদন দের বড় ছেলে রণজিৎ কুমার ও তার স্ত্রী রিনা রাণীকে। সদ্য বিয়ে করেছিলেন তারা। মধুদার হাতে ও পায়ে গুলি করা হলে তিনি আহত হন। মধুদার স্ত্রী যোগমায়া মধুদাকে বাঁচানোর জন্যে প্রাণপণে চেষ্টা করেছিলেন। আর তাই যোগমায়া দেকে মরতে হলো সবচেয়ে নির্মমভাবে। হাত-পা ছিন্নভিন্ন করে ফেলা হয় তার। পরে মধুদাকে আহত অবস্থায় টেনে নিয়ে যাওয়া হয় জগন্নাথ হলে। সেখানে ফায়ারিং স্কোয়াডে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মারা হয় মধুদাকে।

মধুর ক্যান্টিনের বর্তমান মালিক মধুসূদন দের ছেলে অরুণ দে জানান, ২৭ মার্চ পর্যন্ত কেউ তাদের খোঁজখবর করেনি। পরে তার বাবার বন্ধু এসে তিনিসহ ১০ ভাইবোনকে নিয়ে প্রথমে যান গ্রামের বাড়িতে। পরে আগরতলা দিয়ে চলে যান ভারতে। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে ফিরে আসেন দেশে। এসে দেখেন, মধুর ক্যান্টিনের পিলারগুলো ছাড়া সবকিছু তছনছ করে দিয়েছে পাকবাহিনী। এ ধ্বংসস্তুপের মাঝখানে নানা পোস্টার সেঁটে দেওয়া; সেগুলোয় লেখা: ‘মধুদা আমরা আছি, আমরা তোমাকে ভুলব না।’

নতুন করে শুরু

স্বাধীন বাংলাদেশে ১৩৭৯ বঙ্গাব্দের ২০ বৈশাখ নতুন করে খুললো মধুর ক্যান্টিন। ক্লাস ফাইভে পড়ুয়া অরুণ দে বাবার ব্যবসার দায়িত্ব নিলেন। নবকুমার ইন্সটিটিউটের ছাত্র ছিলেন তিনি। স্কুলে যাবার আগে ক্যান্টিন খুলতেন। ফিরে এসে আবার বসতেন। সেখান থেকে এখন পর্যন্ত তিনি চালিয়ে যাচ্ছেন বাবার স্মৃতিবিজড়িত মধুর ক্যান্টিন। মধুর ক্যান্টিনের সামনে মধুসূদন দের একটি ভাস্কর্য আছে। সেখানে লেখা আছে, ‘আমাদের প্রিয় মধুদা।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সুশীল মালাকার বলেন, ‘আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মধুর ক্যান্টিনকে খাওয়া-দাওয়ার রেস্তোরাঁর চাইতে রাজনৈতিক মিটিংয়ের গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবেই চিনি। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে ছাত্রনেতারা সব ধরনের পরিকল্পনা ও আন্দোলনের ছক এখানে বসেই করতেন। কখনো কখনো মধুদার অনুপস্থিতিতে তার সহধর্মিণী যোগমায়া দেবীর কাছে ছাত্ররা বিভিন্ন গোপন খবর রেখে যেতেন। তিনি সেই খবর পৌঁছে দিতেন নির্ধারিত ছাত্রনেতার কাছে। মধুর ক্যান্টিন এখনো রাজনৈতিক আড্ডার কেন্দ্রবিন্দু হয়েই রয়েছে। বিভিন্ন দলের, মতের ও আদর্শের ছাত্ররা এখানে নিয়মিত মিলিত হন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন জানান, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিচক্ষণ ও যোগ্য নেতৃত্ব আসে এই মধুর ক্যান্টিন থেকেই। একসময় ছাত্র আন্দোলনের ঘাঁটি ছিল এই মধুর ক্যান্টিন। ষাট-সত্তরের দশকে মধুর ক্যান্টিনের যে আবেদন ছিল, এখন সেটি আর আগেরমতন করে নেই। মেডিকেল কলেজের পাশ্ববর্তী সেই মধুর ক্যান্টিন ক্রমশ হারিয়ে গেছে। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ক্যান্টিন গড়ে ওঠার কারণে মধুর ক্যান্টিনের সেই মোহটা আর নেই।’

রাজনীতির আঁতুড়ঘর খ্যাত মধুর ক্যান্টিন বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় এক জ্বলজ্বলে অধ্যায়। শুধু রাজনীতি নয়, সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রেও মধুর ক্যান্টিন হয়ে উঠেছিল ছাত্রদের কেন্দ্র। হাজারো ইতিহাসের সাক্ষী হতে আপনিও ঘুরে আসতে পারেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন সংলগ্ন মধুর ক্যান্টিন থেকে। চা কিংবা সিঙ্গারা খেতে খেতে ইতিহাসের অলিগলিতে করতে পারেন ‘টাইম ট্রাভেল’।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০৩১

All Rights Reserved ©2024