বৃহস্পতিবার, ২৬শে জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

নিউইয়র্কের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে কে এই মেয়রপ্রার্থী জোহরান মামদানি?

বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন।। নিউইয়র্ক সিটির মেয়র পদে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পাওয়ার কাছাকাছি চলে আসা ৩৩ বছর বয়সী জোহরান মামদানি ইতিহাস গড়েছেন প্রথম মুসলিম প্রার্থী হিসেবে।

পঁচানব্বই শতাংশ ভোট গণনার পর দেখা যাচ্ছে মামদানি ৪৩ শতাংশ ভোট পেয়ে সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুওমোর চেয়ে এগিয়ে আছেন। কুওমো ২০২১ সালে যৌন হয়রানির অভিযোগে পদত্যাগ করেছিলেন এবং এই প্রাইমারিতে তিনি ৩৬ শতাংশ ভোট পেয়েছেন।

তৃণমূল পর্যায়ের বড় সমর্থন এবং সাহসী বামপন্থী ধারার মধ্য দিয়ে জোহরান মামদানির এই সাফল্য এসেছে।

মামদানি তার সমর্থকদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আজ রাতে আমরা ইতিহাস সৃষ্টি করেছি। আমি নিউইয়র্ক সিটির মেয়র পদে আপনাদের ডেমোক্রেটিক মনোনীত প্রার্থী হব”

নিউইয়র্কের র‍্যাঙ্ক-চয়েস ভোটিং পদ্ধতির কারণে চূড়ান্ত ফলাফলে এখনো পরিবর্তন ঘটতে পারে, তবে মামদানি যে এগিয়ে রয়েছেন তা স্পষ্ট।
সাবেক গভর্নর কুওমোর মতো একসময়ের প্রভাবশালী ব্যক্তির বিপরীতে তার জয় প্রগতিশীলদের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত এবং এটি শহরের রাজনৈতিক কেন্দ্রবিন্দুতে একরকম পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

উগান্ডা থেকে কুইন্সে
মামদানি উগান্ডার কাম্পালায় জন্মগ্রহণ করেন এবং সাত বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে নিউইয়র্কে আসেন। সেখানে তিনি ব্রঙ্কস হাই স্কুল অফ সায়েন্সে পড়াশোনা করেন এবং পরে বোওডেন কলেজ থেকে আফ্রিকানা স্টাডিজে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। সেখানে তিনি “স্টুডেন্টস ফর জাস্টিস ইন প্যালেস্টাইন” এর ক্যাম্পাস শাখার একজন সহ-প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।

মিলেনিয়াল প্রজন্মের এই প্রগতিশীল নেতা, যিনি শহরের প্রথম মুসলিম এবং দক্ষিণ এশীয় মেয়র হবেন, তিনি তার শেকড়ের বৈচিত্র্যকে তুলে ধরে তার ভিত্তিতে এগিয়েছেন।

তিনি তার প্রচারণার একটি ভিডিও পুরোপুরি উর্দু ভাষায় করেছেন এবং তাতে বলিউডের সিনেমার দৃশ্য যুক্ত করেছেন। আরেকটি ভিডিওতে তিনি স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলেছেন।

মামদানির স্ত্রী ২৭ বছর বয়সী ব্রুকলিনের সিরিয়ান শিল্পী রামা দুয়াজি, যার সাথে ডেটিং অ্যাপ “হিঞ্জ” এর মাধ্যমে তার পরিচয় হয়েছিল।

তার মা মীরা নায়ার একজন বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক এবং বাবা অধ্যাপক মাহমুদ মামদানি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। তার বাবা-মা দুজনেই হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী।

মামদানি নিজেকে গণমানুষের প্রতিনিধি এবং সংগঠক হিসেবে উপস্থাপন করেন।

তার স্টেট অ্যাসেম্বলি প্রোফাইলে লেখা হয়েছে, “জীবন যখন অনিবার্য দিকে মোড় নিচ্ছিলো — সিনেমা, র‍্যাপ আর লেখালেখির বাঁকবদলে, যাই হোক না কেন, সবসময়ই সংগঠন করা তার মাঝে এক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। যে কারণে বিশ্বের ঘটনাপ্রবাহ তাকে হতাশা নয়, বরং কাজের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।”

রাজনীতিতে প্রবেশের আগে তিনি আবাসন খাতের একজন কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করেছেন, যার মাধ্যমে কুইন্সে স্বল্প আয়ের বাসিন্দাদের বাড়ি থেকে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে লড়তে সাহায্য করতেন।

মামদানি তার মুসলিম পরিচয়কে তার প্রচারণার অংশ হিসেবে তুলে ধরেছেন। তিনি নিয়মিত মসজিদে গিয়েছেন এবং শহরের উচ্চ জীবনযাত্রার খরচের সংকট নিয়ে উর্দু ভাষায় একটি প্রচারণার ভিডিও প্রকাশ করেছেন।

“আমরা জানি যে, একজন মুসলিম হিসেবে জনসমক্ষে আসার ক্ষেত্রে নিরাপত্তাকে বিসর্জন দিতে হয়” — বসন্তের এক সমাবেশে তিনি এই কথা বলেন।

সামাজিক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংস্থা ড্রামের রাজনৈতিক পরিচালক জাগপ্রীত সিং বলেন, “মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা কারও মধ্যে জোহরানের মতো কাউকে দেখিনি, যিনি সামগ্রিকভাবে আমাদের চিন্তার বিষয়গুলোর প্রতিফলন ঘটান।”

মামদানির সাশ্রয়ী যুদ্ধ
মামদানি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ব্যয়বহুল শহরের ভোটাররা চায় ডেমোক্র্যাটরা সাশ্রয়ের ওপর গুরুত্ব দিক।

“এটি এমন একটি শহর যেখানে চারজনের মধ্যে একজন দারিদ্র্যের সাথে বসবাস করছে, এমন একটি শহর যেখানে প্রতিরাতে পাঁচ লাখ শিশু ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমায়,” বলেন মামদানি।

বিবিসির সাথে এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ-ও বলেন, “এটি এমন একটি শহর যা নিজের সেসব বৈশিষ্ট্য হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে, যেগুলো একসময় এটিকে বিশেষ করে তুলেছিল।”

তার প্রস্তাবনাগুলো হলো:

শহরজুড়ে বিনামূল্যে বাস পরিষেবা।
বাড়িভাড়া স্থির রাখা এবং অবহেলা করা বাড়িওয়ালাদের জবাবদিহির ব্যবস্থা করা।
সাশ্রয়ী মূল্যের ওপর জোর দিয়ে শহরের নিজস্ব মুদি দোকানের চেইন সৃষ্টি করা।
ছয় সপ্তাহ থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের জন্য সারা শহরে বিনামূল্যে চাইল্ড কেয়ার প্রতিষ্ঠা।
সাশ্রয়ী বাসস্থানের সংখ্যা তিন গুণ বাড়ানো, যা ইউনিয়নের মাধ্যমে নির্মাণ করা হবে।
তার পরিকল্পনায় মেয়রের অফিসের ‘পুনর্বিন্যাস’ বা সংস্কারও অন্তর্ভুক্ত, যাতে করে সম্পত্তির মালিকরা দায়বদ্ধ থাকে এবং চিরস্থায়ীভাবে সাশ্রয়ী বাসস্থানের সংখ্যা বাড়ানো যায়।

মামদানি তার প্রচারণায় এই নীতিগুলোকে চোখে পড়ার মতো এবং ভাইরাল, অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে সামনে এনেছিলেন।

তিনি বাসা ভাড়ার বিষয়টি তুলে ধরতে আটলান্টিক সাগরে ডুব দিয়েছেন এবং খাদ্য নিরাপত্তাহীনতাকে তুলে ধরার জন্য একটি বারিতো ( মেক্সিক্যান খাবার) দিয়ে একটি পাতাল রেল সাবওয়েতে রমজানের ইফতার করে রোজা ভাঙেন।

এছাড়া, তিনি ভোটের আগের দিন পুরো ম্যানহাটন হেঁটে গেছেন এবং ভোটারদের সাথে সেলফি তুলেছেন।

যদিও তিনি জোর দিয়ে বলেন, এই শহরকে আরও সাশ্রয়ী করা সম্ভব, তবুও সমালোচকরা মনে করছেন, এই অতি উচ্চাভিলাষী প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন করা কঠিন।

দ্য নিউইয়র্ক টাইমস মেয়র নির্বাচনে কাউকে সমর্থন না দিয়ে সাধারণভাবে প্রার্থীদের সমালোচনা করে থাকে।

তাদের সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে, মামদানির পরিকল্পনা “শহরের চ্যালেঞ্জের সাথে খাপ খায় না” এবং এটি “শাসনের অতি জরুরি সমঝোতাগুলোকে অগ্রাহ্য করে”। তার প্রতিশ্রুত বাসা ভাড়ায় কড়াকড়ি করা হলে আবাসন সংকট বাড়তে পারে বলে তারা মনে করছে।

সমালোচকরা তুলছেন অভিজ্ঞতার প্রশ্ন
কুওমো এবং তার সমর্থকরা মনে করছেন, মামদানি এমন পদের জন্য খুবই অদক্ষ এবং কট্টরপন্থী, যেখানে ১১৫ বিলিয়ন ডলারের বাজেট এবং ৩ লাখের বেশি পৌর কর্মী রয়েছে।

বিল ক্লিনটন সহ বড় দাতা এবং মধ্যপন্থীদের সমর্থন পাওয়া কুওমো অভিজ্ঞতার উপর জোর দিয়ে বলেন, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, কাজ কীভাবে করতে হয়, তা জানা প্রয়োজন । ট্রাম্পের সাথে কীভাবে কাজ করতে হয় এবং ওয়াশিংটনে কীভাবে কাজ করতে হয়, সেগুলোও জানতে হবে। এছাড়া রাজ্যের আইনসভার সাথে কীভাবে কাজ করতে হয়, এসব মৌলিক বিষয়ে জানা প্রয়োজন।

কুওমো বলেন, ‘আমি চাকরির পরের প্রশিক্ষণে বিশ্বাস করি, কিন্তু তা নিউইয়র্কের মেয়র পদে নয়।”

রাজনৈতিক কৌশলবিদ ট্রিপ ইয়াং মনে করেন, এই সময়ে কেবল ‘অভিজ্ঞতা’ দিয়ে আর কাজ হয় না এবং মামদানি না জিতলেও তার প্রচার এমন কাজ করেছে, যা অনেকের কল্পনার বাইরেও ছিল।

“জোহরানকে সমর্থন দিয়েছেন হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক এবং লাখ লাখ ডোনার। নিউইয়র্কের মতো বড় শহরে স্থানীয় ডেমোক্র্যাটিক প্রাইমারিতে এমন তৃণমূল পর্যায়ের আগ্রহ খুব কমই দেখা যায়,” তিনি বলেন।

“তিনি আমাদের বুঝতে পারেন, তিনি আমাদের অংশ, তিনি আমাদের এই অভিবাসী সম্প্রদায়েরই অংশ,” বলেন মামদানির সমর্থক লোকমণি রায়।

ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিন ইস্যু
জ্যাকসন হাইটসের এক পার্কে সম্প্রতি মামদানির প্রচারের সময় শিশুদের খেলা, লাতিন খাবারের দোকান এবং আইসক্রিম বিক্রেতারা যে দৃশ্য তৈরি করেছিলেন, তা অনেক ডেমোক্র্যাটের চোখে নিউইয়র্কের বৈচিত্র্য আর শক্তির প্রতীক। তবে এই শহরটি জাতিগত এবং রাজনৈতিকভাবে তিক্ততার উর্ধ্বে নয়।

মামদানি বলেন, তিনি প্রতিদিন ইসলামবিদ্বেষী হুমকির মুখে পড়েছেন, এমনকি তার পরিবারকেও এর সম্মুখীন হতে হয়েছে। পুলিশের মতে, এই হুমকিগুলো ‘হেট-ক্রাইম’ বা ঘৃণাজনিত অপরাধ হিসেবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

তিনি বিবিসিকে বলেছেন, বর্ণবাদ এমন সমস্যা যা মার্কিন রাজনীতির ভঙ্গুর দিকগুলোর ইঙ্গিত দেয় এবং একটি গণতান্ত্রিক দলের সমালোচনা করেছেন যা “ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পুনরায় নির্বাচিত হতে দিয়েছে” এবং “তারা যেই হোক বা যেখান থেকেই আসুক না কেন” শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে দাঁড়াতে ব্যর্থ হয়েছে।

ভোটারদের মনে সম্ভবত ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধের বিষয়ে প্রার্থীদের অবস্থানের দিকটিও কাজ করেছে। ফিলিস্তিনিদের প্রতি দৃঢ় সমর্থন এবং ইসরায়েলের সমালোচনা করার কারণে ডেমোক্রেটিক পার্টির বেশিরভাগ নেতার সাথে তার মতবিরোধ হয়েছে ।

এই অ্যাসেম্বলি সদস্য এমন বিলেরও প্রস্তাব করেছিলেন, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অমান্য করে ইসরায়েলের বসতি স্থাপনের সাথে সম্পৃক্ত চ্যারিটি প্রতিষ্ঠানের নিউইয়র্কে করমুক্ত সুবিধা বাতিল করবে।

তিনি আরও বলেছিলেন যে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে গ্রেফতার করা উচিত।

অনেকবারই তাকে সাংবাদিকরা জিজ্ঞাসা করেছেন, তিনি ইসরায়েলের “ইহুদি রাষ্ট্র” হিসেবে অস্তিত্বের অধিকারকে সমর্থন করেন কিনা।

একবার তিনি বলেছেন, “ধর্ম বা অন্য কিছুর ভিত্তিতে নাগরিকত্বের শ্রেণিবিন্যাস আছে, এমন কোনো রাষ্ট্রকে সমর্থন করতে আমি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না। আমি মনে করি, এই দেশে আমাদের আধিকার যেভাবে আছে, বিশ্বের প্রতিটি দেশেই সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা উচিত। এটাই আমার বিশ্বাস।”

মামদানি আরও বলেছেন, নিউইয়র্ক সিটিতে ইহুদি-বিদ্বেষের কোনো স্থান নেই, এবং তিনি নির্বাচিত হলে ঘৃণাজনিত অপরাধ প্রতিরোধে তহবিল বাড়াবেন।

অন্যদিকে কুওমো বলেছেন, তিনি “ইসরায়েলের অতি সমর্থক এবং এতে গর্ববোধ করেন”।

অনেক দিক দিয়েই নিউইয়র্কে ডেমোক্র্যাটরা এমন সমস্যার মুখোমুখি যেমনটা পুরো দলকে ভবিষ্যতের জাতীয় নির্বাচনে পার করবে।

এর পরেও দল সম্পর্কে তাদের বক্তব্য এবং ট্রাম্পের প্রতি তাদের কেমন মনোভাব নেওয়া উচিত- তা নিয়ে জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রেও প্রাইমারি নির্বাচনকে বিশ্লেষণ করা হতে পারে।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১৩
১৫১৬১৯২০
২১২২২৩২৪২৫২৬২৭
৩০