
মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ শুরু করলে একের পর এক পতন হতে থাকে হানাদার বাহিনীর বিভিন্ন ঘাঁটির। পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান উভয় রণাঙ্গনে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মনোবলহীন পাকিস্তানি বাহিনী কীভাবে একের পর এক রণাঙ্গন ছেড়ে দিয়েছিল, তার বর্ণনা আছে খোদ পাকিস্তানেরই হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্টে। কমিশন বলেছে, ‘সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হওয়ার চতুর্থ দিনে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নগরদুর্গ বিনা যুদ্ধেই পরিত্যাগ করা হয়; যেমন পশ্চিম দিকে যশোর ও ঝিনাইদহ এবং পূর্ব দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া। পরের দিন কুমিল্লা দুর্গ চারদিক থেকে ঘেরাও হলে সেটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আর ৯ ডিসেম্বর একজন ডিভিশনাল কমান্ডার সেনাদের ফেলে রেখেই হেডকোয়ার্টার্সসহ কর্তব্য এলাকা ত্যাগ করেন। একই দিনে পরিত্যাগ করা হয় কুষ্টিয়া ও লাকসাম। ১০ ডিসেম্বর এমনকি হিলিও ছেড়ে আসতে হয়। ময়মনসিংহ থেকে পিছু হটা ব্রিগেডকে হেলিকপ্টারে করে নেমে আসা ভারতীয় ছত্রীসেনারা ফাঁদে ফেলে এবং সেনাসহ ব্রিগেড কমান্ডার বন্দী হন।’ প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, একাত্তরের ৮ ডিসেম্বর ভীরুতা দেখিয়ে চাঁদপুরে নিজের ডিভিশনের সেনা ও বিপুল সরঞ্জামসহ সবকিছু ফেলে পালিয়েছিলেন রহিম খান। ১২ ডিসেম্বরই তিনি নিয়াজিকে জানান, ‘সব শেষ হয়ে গেছে’। আত্মসমর্পণের আগেই বিশেষ ব্যবস্থায় পাকিস্তানে চলে যান। এ বিষয়ে নিয়াজি তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘আমি গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রসহ মেজর জেনারেল রহিমকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠাই।’ প্রকৃতপক্ষে সেগুলো ছিল বুদ্ধিজীবী হত্যাসহ গণহত্যার গোপন দলিল। জেনারেল ফরমান আলীর পরামর্শে জেনারেল রহিম ১৬ ডিসেম্বর ভোরে গোপন দলিলপত্র নিয়ে মিয়ানমার হয়ে পালিয়ে যান।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিকের বইয়ে উল্লেখ আছে, গভর্নর ডা. মালিক ৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় নিয়াজিকে ডেকে পাঠান গভর্নর হাউসে যুদ্ধের পরিস্থিতি জানতে। কেননা, তিনি পরস্পরবিরোধী সংবাদ পাচ্ছিলেন। …সন্ধ্যায় গভর্নর মালিক, জেনারেল নিয়াজি ও দুজন সিনিয়র অফিসার গভর্নর হাউসের একটি অভিজাত কক্ষে বসেছিলেন। তাঁরা কথা তেমন বলছিলেন না। কয়েক মিনিট পরপর নীরবতা গ্রাস করছিল। গভর্নরই বললেন বেশি। গভর্নর আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছিলেন নিয়াজিকে সান্ত্বনা দিতে। মালিকের কথার শেষ পর্যায়ে নিয়াজির স্থূলকায় শরীর কেঁপে ওঠে। দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে তিনি শিশুর মতো ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেন। তখন এক বাঙালি ওয়েটার কফি আর শুকনো খাবারের ট্রে নিয়ে ওই কক্ষে ঢুকতে গেলে তাঁকে কক্ষ থেকে বের করে দেওয়া হয়। ওয়েটার বাইরে এসে বাঙালি সহকর্মীদের বলেছিল, ‘সাহেবরা ভেতরে কান্নাকাটি করছেন।’ ওয়েটারের ওই বক্তব্য গভর্নরের মিলিটারি সেক্রেটারি শুনে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেন। গভর্নর মালিক পরে নিয়াজিকে বলেন, অস্ত্র সংবরণের জন্য তিনি প্রেসিডেন্টকে জানানোর কথা ভাবছেন।
সিদ্দিক সালিকের মতে, বৈঠকের পর গভর্নর একটি বার্তা পাঠান প্রেসিডেন্টকে। যদিও ওই বার্তা আমলে নেননি ইয়াহিয়া। নিয়াজি সেনাসদরে গিয়ে পরবর্তী তিন রাত নিষ্ক্রিয় থাকেন। তিনটা রাত—৭, ৮ ও ৯ ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজির ওপর বড্ড ভারী হয়ে চাপে। নিয়াজির ফুর্তিভাব নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। কারও সঙ্গে তেমন কথা বলতেন না।
চোখে নিদ্রাহীনতার চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ওই সময় বিবিসি খবর দিয়েছিল, সৈন্যদের বিপজ্জনক অবস্থায় রেখে নিয়াজি আকাশপথে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গেছেন। ১০ ডিসেম্বর নিয়াজি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে গিয়ে লাউঞ্জে প্রথম যাকে পেলেন তাঁকেই বললেন, ‘বিবিসির লোকটি কোথায়? আমি তাঁকে বলতে চাই, সর্বশক্তিমান আল্লাহর কৃপায় আমি এখনো পূর্ব পাকিস্তানেই আছি।’
সিদ্দিক সালিকের দাবি, একমাত্র ৯ ডিসেম্বর সকালেই ইস্টার্ন কমান্ড সদর দপ্তর প্রথমবারের মতো স্বীকার করল যে পরিস্থিতি ‘দারুণ সংকটপূর্ণ’। এ বিষয়ে একটি সংকেতবার্তাও পাঠানো হলো। গভর্নর মালিকও ৯ ডিসেম্বর ইয়াহিয়া খানের কাছে একটি বার্তা পাঠিয়ে দ্রুত যুদ্ধ বন্ধের ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন। ইয়াহিয়া খান গভর্নর মালিক ও পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক নিয়াজিকে তাঁদের বিবেচনামতো সিদ্ধান্ত নিতে বলেন। পাকিস্তানের সিওএস জেনারেল হামিদ ১০ ডিসেম্বর এক বার্তায় নিয়াজিকে উপদেশ দেন যুদ্ধ-সরঞ্জাম যতটা সম্ভব ধ্বংস করে ফেলতে এবং অপারেশনাল পরিস্থিতির সুস্পষ্ট তথ্য গভর্নরকে জানাতে, যাতে তিনি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। গভর্নর যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে প্রথমে ঢাকায় অবস্থানরত জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব পল মার্ক হেনরির শরণাপন্ন হন।
এদিকে গভর্নর মালিক ১৪ ডিসেম্বর দুপুরে গভর্নর হাউসে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সভা ডাকেন। তাতে কর্মকর্তারা যোগ দেওয়ার আগেই ভারতীয় বিমান গভর্নর হাউসে বেশ কয়েকটি বোমা ফেলে। গভর্নর মালিক ভীত হয়ে পদত্যাগপত্রে সই করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আশ্রয় নেন। সিদ্দিক সালিকের মতে, ১৪ ডিসেম্বর ছিল পূর্ব পাকিস্তান সরকারের শেষ দিন। ১৪ ডিসেম্বরই ইয়াহিয়া বার্তা পাঠিয়ে যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দেন। নিয়াজির কাছে তারবার্তা এসে পৌঁছায় বিকেল সাড়ে ৫টায়। এরপর নিয়াজি ও ফরমান আলী যান মার্কিন কনসাল জেনারেল হার্বার্ট স্পিভাকের কাছে। প্রথমে নিয়াজি ভেতরে ঢোকে স্পিভাককে অনুরোধ করেন ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করতে।
স্পিভাক বললেন, তিনি নিয়াজির হয়ে আলোচনা চালাতে পারেন না; তবে একটি বার্তা পাঠাতে পারেন। তখন ফরমানকে ডাকা হয় ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশর জন্য একটি বার্তা তৈরি করতে। যুদ্ধবিরতির শর্তসংবলিত বার্তাটি তৈরি করা হলে স্পিভাক জানান, ২০ মিনিটের মধ্যেই পাঠিয়ে দেবেন। নিয়াজি ও ফরমান চলে এসে জবাবের প্রতীক্ষায় থাকেন।
ফরমান আলীর মতে, ১৬ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ৯টায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর জেনারেল নাগরা মিরপুর সেতুর কাছে থাকার কথা জানিয়ে এক চিরকুটে নিয়াজিকে প্রতিনিধি পাঠাতে বলেন। নাগরাকে অভ্যর্থনা জানাতে নিয়াজি পাঠান জেনারেল জামশেদকে। …জেনারেল নাগরা কয়েকজন সৈন্য নিয়ে গৌরবের শিরোপাসহ ঢাকায় ঢোকেন।
অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করে। নিয়াজি বিকেল ৪টা ৩১ মিনিটে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মিত্রবাহিনীর কমান্ডার জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা এবং বাংলাদেশের গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারের কাছে আত্মসমর্পণ করেন।
প্রথমে জেনারেল নিয়াজি দলিলে সই করেন, তারপর জেনারেল অরোরা। অনুষ্ঠানে ছিলেন ভারতীয় নৌবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান অ্যাডমিরাল এন কৃষ্ণানও।
অ্যাডমিরাল কৃষ্ণান তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘জানি না, জেনারেল নিয়াজি জেনেশুনেই করেছিলেন নাকি খেয়াল করেননি, তবে তিনি নিজের পুরো নাম সই করেননি, শুধু ‘‘এ. কে.’’ লিখেছিলেন। আমার নজরে পড়তেই জেনারেল অরোরাকে বললাম ব্যাপারটা। অরোরা তখনই নিয়াজিকে অনুরোধ করেন পুরো নাম সই করতে। যেই নিয়াজি পুরো নাম সই করলেন, সে মুহূর্তেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেল।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘সই করার পরেই নিয়াজির চোখে পানি এসে গিয়েছিল। টুপি খুলে দিলেন, আর রিভলবার থেকে গুলি বের করে সেগুলো জেনারেল অরোরার সামনে সমর্পণ করলেন।’