রবিবার, ৫ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

বিস্ময়কর রেকর্ড গড়তে যাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প

আধুনিক প্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ১৯৭০ এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ইতিহাসে সংযোজন করা হয়েছিল মডার্ন নমিনেশন প্রক্রিয়া। এরপর পর্যায়ক্রমে ১০ জন ডেমোক্র্যাট ও ১০ জন রিপাবলিকান দলীয় প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী দীর্ঘ পথ পরিক্রমণ এবং তীব্র প্রতিযোগিতার সাগর পাড়ি দিয়ে দলীয় মনোনয়ন লাভ শেষে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। রিপাবলিকান দলীয় মনোনয়নের প্রশ্নে মডার্ন নমিনেশন প্রক্রিয়ার ইতিহাসে এবার ভাগ্যের বরপুত্র হিসেবে আবির্ভূত হতে চলেছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত অনুসারে, রিপাবলিকান দলীয় মনোনয়ন প্রশ্নে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী ও অভিনব রেকর্ড সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন ট্রাম্প। অবিশ্বাস্য শোনালেও ২০২৪ রিপাবলিকান প্রেসিডেন্সিয়াল মনোনয়নের জন্য ট্রাম্পকে শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ পথ মাড়াতে হচ্ছে না। সাউথ ক্যারোলিনার সাবেক গভর্নর এবং জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালি ২৪ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য হোম স্টেট সাউথ ক্যারোলিনার রিপাবলিকান প্রাইমারি পর্যন্ত ট্রাম্পের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়ার দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করলেও জনজরিপে তার অবস্থান একেবারেই নড়বড়ে। সাউথ ক্যারোলিনা পলিং এভারেজে ট্রাম্প প্রতিপক্ষ হ্যালির তুলনায় কমপক্ষে ৩০ শতাংশ ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন। তাই সাউথ ক্যারোলিনায় ব্যাপক ব্যবধানে ট্রাম্পের নিকট হেরে গেলে নিকি হ্যালির পক্ষে ২৭ ফেব্রুয়ারি মিশিগানে অনুষ্ঠিতব্য প্রাইমারিতে অংশ নেওয়া হবে নিছক আনুষ্ঠানিকতার নামান্তর।
তাই ১৩ সম্ভাব্য প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে দলীয় মনোনয়ন লড়াইয়ের সূচনা হলেও ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে নিকি হ্যালি বিদায় নিলে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রিপাবলিকান দলীয় মনোনয়নের ক্ষেত্রে গড়বেন নতুন ইতিহাস। এর ফলে মডার্ন নমিনেশন প্রক্রিয়ার ইতিহাসে এবারের প্রেসিডেন্সিয়াল প্রাইমারি প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে সর্বাপেক্ষা সংক্ষিপ্ত এবং ট্রাম্প হবেন মহাকাব্যের মহানায়ক। ইতিহাসের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, রিপাবলিকান দলীয় মনোনয়ন প্রশ্নে ইতিপূর্বে প্রত্যেক প্রার্থীকে দীর্ঘ পথ মাড়াতে এবং বাঘে-মোষে লড়াই করতে হয়েছে। কিন্তু রিপাবলিকান দলে অতিমাত্রায় আস্থাভাজন এবং রাজনৈতিক দূরদর্শিতার কারণে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অতি সংক্ষিপ্ত কণ্টকাকীর্ণ পথই মাড়াতে হচ্ছে। ফেব্রুয়ারির শেষ নাগাদ পাঁচটি স্টেটের সব কটি এবং ইউএস ভার্জিন আইল্যান্ডসে রিপাবলিকান প্রাইমারির ইতি ঘটবে। আর ৩ মার্চ ডেমোক্র্যাটিক প্রতিদ্বন্দ্বিতারও সমাপ্তি ঘটবে।
৬ জানুয়ারির পুনরাবৃত্তির শঙ্কা : আমেরিকার গণতন্ত্র রুগ্্ণ এবং শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছে। ডিসেম্বরে গ্যালাপের এক জরিপে সিংহভাগ আমেরিকান দেশের গণতন্ত্রের রুগ্্ণদশা নিয়ে চরম অসন্তোষ এবং মাত্র ২৮ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক আমেরিকান নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। পক্ষান্তরে ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারির ক্যাপিটল দাঙ্গার পর ৩৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক দেশের গণতন্ত্র নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। ৩০ নভেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত এপি-নরক পরিচালিত জরিপে অংশগ্রহণকারী ৬৭ শতাংশ উত্তরদাতা বলেন, ২০২৪ সালের নির্বাচনে কোনো ধরনের অনিয়ম বা জালিয়াতির অভিযোগ আমেরিকার ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রের জন্য ভয়ানক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। তারা বলেন, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ট্রাম্প উভয়কে যেকোনো ধরনের অনিয়মের ব্যাপারে কঠোর সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
এদিকে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক গণতন্ত্রের শিক্ষক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের খ্যাতনামা অধ্যাপক সুসান স্টোকস বলেন, ২০২০ সালের নির্বাচনে বড় ধরনের জালিয়াতি হয়েছেÑট্রাম্প ও রিপাবলিকানদের তা জনসম্মুখে সঠিকভাবে তুলে ধরতে হয়েছিল। ফলে জনগণ চটে গিয়েছিল। এরই পটভূমিতে ৬ জানুয়ারির ক্যাপিটল দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছিল। আগস্টে মর্নিং কনসাল্ট/বাইপার্টিশান পলিসি সেন্টার পরিচালিত জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৮২ শতাংশ ভোটার আমেরিকার গণতন্ত্র নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। আর জানুয়ারিতে ইউগভ/সিবিএস নিউজ পরিচালিত জরিপে অংশগ্রহণকারী ৫০ শতাংশ ভোটার শক্তিশালী অর্থনীতির চেয়েও আমেরিকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনাকে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছিলেন। ডিসেম্বরে নেভিগেটর জরিপে ৬৬ শতাংশ উত্তরদাতা ৬ জানুয়ারির পুনরাবৃত্তির এবং ৮৫ শতাংশ ভবিষ্যতে রাজনৈতিক সহিংসতার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। আবার জরিপে অংশগ্রহণকারী রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট উভয় দলের উত্তরদাতারাই গণতন্ত্র, বিশেষত রাজনৈতিক বিভক্তির কারণে গণতন্ত্রের করুণ দশা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। নেভিগেটর জরিপে অংশগ্রহণকারী ৮৭ শতাংশ ডেমোক্র্যাট ৬ জানুয়ারির পুনরাবৃত্তির পুরোপুরি আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। এ ছাড়া ৯৪ শতাংশ ডেমোক্র্যাট এবং ৭০ শতাংশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট উত্তরদাতা বলেন, হামলায় অংশগ্রহণকারী শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদী দাঙ্গাবাজদের রিপাবলিকান পার্টির নির্দেশনা কার্যকরে অর্থবহ ভূমিকা পালনের জন্য কংগ্রেসের রিপাবলিকান সদস্যরা ৬ জানুয়ারির দাঙ্গার সংগঠকদের সাহায্য ও উদ্দীপ্ত করছেন এবং নতুন হামলায় ইন্ধন জোগাচ্ছেন। আবার ৬৯ শতাংশ ডেমোক্র্যাট ও ইন্ডিপেন্ডেন্ট উত্তরদাতার মতে, রিপাবলিকান পার্টি এবং ১৫ শতাংশ উত্তরদাতার মতে, ডেমোক্র্যাটরা রাজনৈতিক সহিংসতাকে আশকারা দেন।
ভোট কারচুপির সংশয় : ২০২৪ প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে ভোটার ম্যানিপিউলেশন থেকে দৈহিক সহিংসতার মতো জটিলতার আশঙ্কা রয়েছে এবং তা শনাক্তপূর্বক মোকাবিলার প্রস্তুতি নিচ্ছে কর্তৃপক্ষ। নির্বাচনী বৈধতাকে হুমকির মুখে ঠেলে দেওয়ার জন্য অনলাইন কর্মকাণ্ড, হামলা পর্যন্ত গড়ানোর মতো সম্ভাব্য বৈশ্বিক বাস্তব ষড়যন্ত্রের নীলনকশা এবং জরুরি ভিত্তিতে তা মোকাবিলার প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে হামল্যান্ড সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্টের গোপনীয় বিশ্লেষণে। এবিসি নিউজের প্রাপ্ত হোমল্যান্ড সিকিউরিটির ২ জানুয়ারির বুলেটিনে বলা হয়েছে, নির্বাচনের দিনক্ষণ যতই ঘনিয়ে আসছে, ভোটিং লোকেশন, সরকারি স্থাপনা, পাবলিক সভা-সমিতি, ব্যালট বাক্স লোকেশন কিংবা নির্বাচন সমর্থনকারী প্রাইভেট সেক্টর ভেন্ডার লোকেশনে হামলার আশঙ্কা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। নির্বাচনের নয় মাস বাকি থাকতেই দেশের অভ্যন্তরে বাইপার্টিশান উত্তেজনা তুঙ্গে উঠতে চলেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্টের সাবেক ইন্টেলিজেন্স প্রধান ও বর্তমানে এবিসি নিউজ কন্ট্রিবিউটর জন কোহেন বলেন, আমরা উচ্চ ধরনের বিপজ্জনক এবং পূর্ণ ঘূর্ণিঝড় অভিমুখে এগোচ্ছি। তিনি বলেন, বিদেশি ও অভ্যন্তরীণ হুমকিদাতারা নিজস্ব নীতিগত এবং ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য এবারের নির্বাচনকে নস্যাতের চেষ্টা করবে, শুধু তা-ই নয়; আমরা আরও শঙ্কা করতে পারি, নির্বাচনের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাজনৈতিক বক্তব্য-বিবৃতি অধিকতর মেরুকরণীয়, অধিকতর ক্রোধপূর্ণ এবং বিভক্তিপূর্ণ হয়ে পড়বে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দৃষ্টিতে সব মিলিয়ে পরিস্থিতির চরম অবনতির আশঙ্কা রয়েছে । মূলত সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে চারটি বিচারাধীন ফৌজদারি, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউক্রেন সংঘাতের ধারাবাহিকতার পাশাপাশি বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য, সামাজিক মাধ্যমে সঠিক/বেঠিক খবরাখবর ও উসকানিমূলক শব্দচয়ন এবং দ্রুত বিকাশমান প্রযুক্তির ভঙ্গুর দশাÑসব মিলিয়ে বড় ধরনের অশুভ ইঙ্গিত দিচ্ছে।
৪৮ শতাংশ আমেরিকানের নির্বাচনের আগেই ট্রাম্পের বিচার দাবি : এসএসআরএস পরিচালিত সিএনএনের এক নতুন জরিপ প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিল দাঙ্গাসহ ট্রাম্পের বিরুদ্ধে চারটি ফৌজদারি মামলার বিচারকাজ ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগেই সম্পন্নের দাবি জানিয়েছেন ৪৮ শতাংশ আমেরিকান। আর ১১ শতাংশ উত্তরদাতার মতে, নির্বাচন পর্যন্ত বিচারকাজ স্থগিত রাখা উচিত বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ৭২ শতাংশ ডেমোক্র্যাট এবং ৫২ শতাংশ ইন্ডিপেন্ডেন্টের মতে, বিচারকাজ অপরিহার্য। আর বিচারকাজ অপরিহার্য দাবিদার ২০ শতাংশসহ ৩৮ শতাংশ রিপাবলিকানও নির্বাচনের আগেই বিচারকাজ দাবি করেছেন। তবে ৩৯ শতাংশ রিপাবলিকানের মতে, কখন বিচারকাজ অনুষ্ঠিত হবে, তা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। অন্যদিকে ২৩ শতাংশ রিপাবলিকানের দাবি, নির্বাচনের পরই বিচারকাজ অনুষ্ঠিত হোক। আবার ৪২ শতাংশ উত্তরদাতার বিশ্বাস, সুপ্রিম কোর্ট সঠিক সিদ্ধান্ত প্রদান করবেন। ৩৫ শতাংশ উত্তরদাতার সুপ্রিম কোর্টের প্রতি আস্থা অনেকটা নড়বড়ে এবং ২৩ শতাংশ পুরোপুরি আস্থাহীন। আবার ৫২ শতাংশ রিপাবলিকান এবং ৩৬ শতাংশ ডেমোক্র্যাটদের বিশ্বাস, সুপ্রিম কোর্ট সঠিক সিদ্ধান্ত প্রদান করবেন। তবে সমষ্টিগতভাবে ৩৫ শতাংশ উত্তরদাতা সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানোর কথা বলেছেন। ক্যাপিটল হিল দাঙ্গাকে ৪৫ শতাংশ উত্তরদাতা বেআইনি, ৩৫ শতাংশ উত্তরদাতা নৈতিকতা-বহির্ভূত এবং ২৩ শতাংশ আদৌ অন্যায় কাজ নয় বলে মন্তব্য করেছেন।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০
১১১২১৩১৪১৫১৬১৭
১৮১৯২০২১২২২৩২৪
২৫২৬২৭২৮২৯৩০৩১

All Rights Reserved ©2024