মঙ্গলবার, ১৬ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

বেকারত্ব তৈরির ফাঁদে মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা

দেশে প্রতি বছর কওমি ও আলিয়া ধারার মাদ্রাসা থেকে প্রায় দুই লাখ শিক্ষার্থী স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। তবে আধুনিক কারিগরি ও পেশাভিত্তিক শিক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকায় তাদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের সুযোগ একেবারেই সীমিত। কেবল একটি ধারায় শিক্ষা নেয়া এসব গ্র্যাজুয়েটের সিংহভাগই থাকছেন বেকার, কিংবা বাধ্য হচ্ছেন অনানুষ্ঠানিক পেশায় যুক্ত হতে। অনেকে আবার নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেই যুক্ত হচ্ছেন যৎসামান্য বেতনে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আধুনিক কারিকুলামের অভাব, মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের দক্ষতা নিয়ে নেতিবাচক ধারণা, কওমি ধারার সব স্তরের স্বীকৃতি না থাকাসহ বিভিন্ন কারণে তারা দেশের আনুষ্ঠানিক শ্রমবাজারে প্রবেশ করতে পারছেন না। তাই কর্মমুখী শিক্ষা ও প্রযুক্তিগত দক্ষতার সমন্বয় না ঘটলে এসব শিক্ষার্থী আরো বেশি সংখ্যায় প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থান থেকে ছিটকে পড়বেন। হতাশা বাড়বে বিশাল এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে।

পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার বাসিন্দা মো. আল-আমিন। ফাজিল (স্নাতক সমমান) ডিগ্রি সম্পন্ন করেন ২০২২ সালে। এরপর প্রায় তিন বছর চেষ্টা করেও আশানুরূপ চাকরি পাননি। বর্তমানে তিনি কৃষিপণ্যের ব্যবসা করছেন। মো. আল-আমিন বলেন, ‘সরকারি চাকরি অনেক সময়সাপেক্ষ হওয়ায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যোগদানের চেষ্টা করেছিলাম। বেশ কয়েকটিতে ভাইভাও দিয়েছি। কিন্তু কোথাও সুযোগ পাইনি। মাঝে আট মাস স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেছি। তবে সেখানে বেতন অনেক কম ও অনিয়মিত ছিল। এসব কারণে ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করেছি।’

মো. আল-আমিন আরো বলেন,

‘আমাদের সমাজে প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে মাদ্রাসা শিক্ষা এখনো মূল স্রোতে চলতে পারছে না। আমি যেসব জায়গায় ভাইভা দিয়েছি, সেখানে নিয়োগকর্তাদের প্রশ্নের ধরন এবং কথাবার্তায় মনে হয়েছিল তারা মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের কর্মদক্ষতা বিষয়ে আস্থার ঘাটতিতে রয়েছেন। তাদের হয়তো ধারণা ছিল আমার স্নাতক সমমানের ডিগ্রি থাকলেও মাদ্রাসা শিক্ষার্থী হওয়ায় দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে।’

শুধু আল-আমিন নন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মতামত এবং গবেষণায়ও উঠে এসেছে, মাদ্রাসা শিক্ষিতদের একটি বড় অংশ তাদের একাডেমিক যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পাচ্ছেন না। বিগত কয়েক বছরে মাদ্রাসা শিক্ষায় উল্লেখযোগ্য হারে শিক্ষার্থী বাড়লেও সে তুলনায় কর্মক্ষেত্রে তাদের সুযোগ বাড়েনি। বর্তমানে দেশে মাদ্রাসা শিক্ষায় প্রধান দুটি ধারা রয়েছে। একটি আলিয়া এবং অন্যটি কওমি। দুই ধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি বছর প্রায় দুই লাখ শিক্ষার্থী স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সমমানের ডিগ্রি সম্পন্ন করছেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, কয়েক বছর ধরেই দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। প্রতিষ্ঠানটির শ্রমশক্তি জরিপ ২০২৩ অনুসারে, দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকার অর্থাৎ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, মাদ্রাসা থেকে স্নাতক-স্নাতকোত্তর সম্পন্নকারী বেকারের সংখ্যা ৯ লাখ ৬ হাজার। এর আগে ২০২২ সালে ছিল ৭ লাখ ৯৯ হাজার। অর্থাৎ এক বছরে উচ্চশিক্ষিত বেকার বেড়েছে প্রায় ১ লাখ ৭ হাজার জন। সাধারণ ধারার তুলনায় শ্রমবাজারে অধিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন মূলত উচ্চশিক্ষিত মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা।

কক্সবাজার জেলায় ‘এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড এক্সপেকটেশনস অব ফরমার মাদ্রাসা স্টুডেন্টস ইন কক্সবাজার: আ ক্রস-সেকশনাল এক্সপ্লোরেশন’ শীর্ষক এক গবেষণা পরিচালনা করে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি)। তাতে দেখা গেছে, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক চাকরি করেন মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের মাত্র ৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ। তাদের মধ্যে আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের মধ্যেই চাকরির হার বেশি, ৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ। বিভিন্ন পর্যায়ের মোট ৭৮২ কওমি ও আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। এসব শিক্ষার্থীর বড় অংশই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায় নিয়োজিত। একই চিত্র উঠে এসেছে অন্যান্য জেলার মাদ্রাসা গ্র্যাজুয়েটদের বক্তব্যেও।

সিলেটের অন্যতম কওমি মাদ্রাসা কাজির বাজারের জামেয়া মাদানিয়া ইসলামিয়া থেকে দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স সমমান) সম্পন্ন করেছেন মো. আবদুল্লাহ। বর্তমানে তিনি প্রিন্টিং ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত। আবদুল্লাহ জানান, গত বছর কওমি মাদ্রাসা থেকে মাস্টার্স পাস করেছেন। প্রথমে একটি মাদ্রাসায় পড়াতেন। তবে আর্থিক সচ্ছলতা নিশ্চিতে কিছুদিন থেকে তিনি প্রিন্টিং ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন। বর্তমানে নগরীর লালদীঘির পারে মার্কেটে প্রিন্টিং প্রতিষ্ঠান খুলেছেন। তার মতো আরো অনেক মাদ্রাসা শিক্ষার্থীই জীবিকার জন্য এ ধরনের ব্যবসা বেছে নিয়েছেন বলেও জানান মো. আবদুল্লাহ।

এদিকে বিভিন্ন খাতের অনেক প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, যুগোপযোগী কারিকুলামের অভাবে পিছিয়ে পড়ছেন মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা। বিডিজবস ডটকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফাহিম মাশরুর বলেন, ‘আনুষ্ঠানিক কর্মক্ষেত্রে এখনো মাদ্রাসা গ্র্যাজুয়েটদের উপস্থিতি কম। তারা সাধারণ গ্র্যাজুয়েটদের তুলনায় কম মেধাবী বিষয়টি এমন নয়। তবে যোগাযোগ দক্ষতা, প্রযুক্তিগত দক্ষতায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা তুলনামূলকভাবে এগিয়ে থাকেন আর এ কারণে চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রেও তারা এগিয়ে যান। মাদ্রাসা শিক্ষার কারিকুলাম আধুনিকায়ন ও শ্রমবাজারের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা হলে শিক্ষার্থীদের এ সংকট কেটে যাবে।’

দেশে মাদ্রাসার দুই ধারার মধ্যে আলিয়া পরিচালিত হয় সরকারি নীতিমালার অধীনে। এ ধারায় স্নাতক পর্যায়ের ডিগ্রি ফাজিল এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ডিগ্রি কামিল নামে পরিচিত। এদের মধ্যে তিন বছর মেয়াদি পাস কোর্স এবং চার বছর মেয়াদি স্নাতক দুই ধরনের ফাজিল ডিগ্রি রয়েছে। সাধারণত প্রায় ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থীই তিন বছর মেয়াদি ফাজিল সম্পন্ন করেন। সর্বশেষ প্রকাশিত শিক্ষা পরিসংখ্যান—‘বাংলাদেশ শিক্ষা পরিসংখ্যান ২০২৩’-এর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত কয়েক বছর ধরে প্রতি বছর ফাজিল ও কামিল সম্পন্ন করেন প্রায় দেড় লাখের বেশি শিক্ষার্থী।

পরিসংখ্যানের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ৭৮ হাজার ৭৪২ জন ফাজিল ও ২৩ হাজার ৬০৭ জন কামিল, ২০২০ সালে ১ লাখ ১৭ হাজার ২৩১ জন ফাজিল ও ৬২ হাজার ৬৯৭ জন কামিল, ২০২১ সালে ১ লাখ ৮ হাজার ৯২০ জন ফাজিল ও ৪০ হাজার ৪৯৮ জন কামিল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তবে করোনাকালীন সেশনজট, শিক্ষার্থী ঝরে পড়াসহ বিভিন্ন কারণে ২০২২ সালে ফাজিল পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা কম ছিল। ওই বছর ৩০ হাজার ৬৫৮ জন ফাজিল পরীক্ষায় ও ৬১ হাজার ৯৯৪ জন উত্তীর্ণ হন কামিলে।

ব্র্যাকের গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ফাজিল-কামিল সম্পন্নকারীদের মাত্র ৩২ শতাংশ জানিয়েছেন কর্মক্ষেত্রে তারা তাদের একাডেমিক শিক্ষাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পেরেছেন। ৪২ শতাংশ জানিয়েছেন তাদের একাডেমিক শিক্ষা কর্মক্ষেত্রে কিছুটা কাজে লেগেছে আর ২৬ শতাংশ জানিয়েছেন তাদের কর্মক্ষেত্রে একাডেমিক শিক্ষা কাজে লাগেনি। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির কারণে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হয় না এবং এ কারণেই শিক্ষার্থীদের বড় অংশই অনানুষ্ঠানিক কর্ম খাতকে বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন।

সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়া, ঢাকার সাবেক শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘যারা মাদ্রাসা থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করে সাধারণ ধারায় স্নাতক-স্নাতকোত্তর করেছেন, তারা সাধারণত কর্মক্ষেত্রে অধিক সফল হন। আমরা যারা মাদ্রাসা থেকে স্নাতক-স্নাতকোত্তর শেষ করেছি, তারা চাকরি ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন উপেক্ষার শিকার হচ্ছি। আমাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকলেও সে অনুযায়ী চাকরি পাচ্ছি না। অনেকেই মনে করেন আমরা ইংরেজি, কম্পিউটার শিক্ষা বা বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে দুর্বল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বিষয়টা এমন নয়। আমাদের সিলেবাস দেখলে আপনারা বুঝবেন সেখানে ইসলামী শিক্ষার পাশাপাশি এসব বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত থাকে। তবে চাকরিদাতারা এসব বিবেচনা না করেই একটি বদ্ধমূল ধারণা থেকে আমাদের বিবেচনা করেন এবং আমরা চাকরিবঞ্চিত হই। ফলে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই ব্যবসা বা স্বল্প বেতনের চাকরিতে যোগদানে বাধ্য হন।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের শিক্ষার্থীদের বড় অংশই শিক্ষকতায় নিয়োজিত। কিন্তু সাধারণ স্কুলগুলোর তুলনায় মাদ্রাসা শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা কম। এছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠানে বিশেষ করে মফস্বল এলাকায় বেতন-ভাতা অনিয়মিত।’

বর্তমানে আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের ফাজিল এবং কামিল পর্যায়ের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয় ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন। বিশ্ববিদ্যালয়টির কামিল (স্নাতকোত্তর) শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রের ডিন প্রফেসর ড. মোহাম্মদ অলী উল্যাহ বলেন, ‘গত কয়েক বছরে মাদ্রাসা শিক্ষায় অনেক আধুনিকায়ন হচ্ছে। অনেক শিক্ষার্থী কর্মক্ষেত্রে ভালোও করছেন। তবে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির জায়গা থেকে কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। এখনো অনেকেই মনে করেন মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। এ ধারণা থেকে অনেক চাকরিদাতা তাদের উপেক্ষা করেন। এ ধরনের ধারণা থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। একজন কোন ধারা থেকে পড়েছেন সেটি বিবেচনা না করে তার দক্ষতাকে বিবেচনায় নেয়া উচিত। এমনটি করা হলে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা চাকরির ক্ষেত্রে আরো এগিয়ে যাবে।’

আলিয়া মাদ্রাসার মতো শিক্ষার্থী বাড়ছে কওমি মাদ্রাসাগুলোয়ও। কওমি ধারায় স্নাতক পর্যায়কে ফযীলত বলা হয়। আর এ ধারায় সর্বোচ্চ পরীক্ষা ‘দাওরায়ে হাদিস’। এ স্তরকে সরকার মাস্টারস সমতুল্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে ফযীলতসহ এর আগের স্তরগুলোর কোনো স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। কওমি মাদ্রাসাগুলো এখনো সরকারি নীতিমালার আওতাভুক্ত হয়নি। দেশে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা কার্যক্রম বর্তমানে ছয়টি বৃহৎসহ অল্প কিছু ছোট বোর্ডের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় বোর্ড ধরা হয় বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশকে (বেফাক)। এ বোর্ডের অধীন ২০২০ সালে ১৩ হাজার ১৯৬ জন, ২০২১ সালে ১৬ হাজার ৩৪১, ২০২২ সালে ১৬ হাজার ৫৭৬, ২০২৩ সালে ১৯ হাজার ৮৭৬ এবং ২০২৪ সালে ২৪ হাজার ৯৭ জন উত্তীর্ণ হয়েছেন।

সরকার দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্স সমতুল্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার পর বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া, বেফাকুল মাদারিসিল কওমিয়া গওহরডাঙ্গা, আযাদ দ্বীনী এদারায়ে তা’লীম, তানযীমুল মাদারিসিদ দ্বীনিয়া, আঞ্জুমানে ইত্তেহাদুল মদারিস ও বেফাকুল মাদারিসিদ্দীনিয়্যা বাংলাদেশ—এ ছয়টি বোর্ড নিয়ে আল-হাইআতুল উলইয়া লিল-জামি’আতিল কওমিয়া বাংলাদেশ নামে একটি বোর্ড গঠন করা হয়। দাওরায়ে হাদিস পরীক্ষা এ বোর্ডের অধীনেই অনুষ্ঠিত হয়। ২০২৫ সালে এ পরীক্ষায় ২৭ হাজার ৯৬৩ জন উত্তীর্ণ হয়েছেন। এর আগে ২০২৪ সালে ২৮ হাজার ২৭৯ জন ও ২০২৩ সালে ২২ হাজার ৫৩৯ জন উত্তীর্ণ হন।

কওমি ধারার শিক্ষার্থীরাও কর্মক্ষেত্রে একই ধরনের অবস্থার মুখোমুখি হচ্ছেন। এ ধারার শিক্ষার্থীদের অন্যতম চ্যালেঞ্জ দাওরায়ে হাদিস ছাড়া বাকি স্তরগুলোর সরকারি স্বীকৃতি না থাকা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসার সাবেক শিক্ষার্থী মো. রিয়াদ বলেন, ‘বর্তমানে আমি একটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে আছি এবং একটি মসজিদে ইমামতি করছি। আমাদের মাদ্রাসা বাংলাদেশের মধ্যে বেশ স্বনামধন্য হওয়ায় আমাদের শিক্ষার্থীরা সাধারণত বেকার থাকে না। তবে সরকারি চাকরি বা সমাজে যেসব চাকরিকে গুরুত্ব দেয়া হয় সেসব জায়গায় আমাদের অংশগ্রহণ কম। এর কারণ এটা নয় যে আমাদের দক্ষতা নেই, এর কারণ সরকারের আন্তরিকতার ঘাটতি। কওমি ধারায় অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী আছে। তারা আরবি ভাষায় অত্যন্ত দক্ষ। এছাড়া এখন বেশির ভাগ মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীদের ইসলামী শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক শিক্ষাও দেয়া হয়। সরকার চাইলে বিদেশী দূতাবাসসহ বিভিন্ন জায়গায় তাদের কাজে লাগাতে পারে। কিন্তু সেটি করা হয় না।’

মো. রিয়াদ আরো বলেন, ‘সরকার দাওরায়ে হাদিসকে স্বীকৃতি দিলেও সেটি কাজে লাগানোর সুযোগ খুবই কম। যেমন সরকারি চাকরির জন্য অনলাইনে আবেদন পদ্ধতিতে সিজিপিএ চাওয়া হয় কিন্তু আমাদের ফলাফল সিজিপিএ-ভিত্তিক না। আমাদের জন্য সেখানে কোনো অপশনই নেই।’

বিআইজিডির গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের মাত্র ২ দশমিক ১৭ শতাংশ সরকারি বা বেসরকারি চাকরিতে নিযুক্ত। তাদের প্রায় ৪৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ মসজিদসহ ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইমাম, মুয়াজ্জিন, খতিব বা শিক্ষকতায় নিযুক্ত এবং বাকিরা অন্যান্য পেশায়।

চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার সহকারী পরিচালক মুফতি জসিম উদ্দীন বলেন, ‘অধিকাংশ শিক্ষার্থী মাদ্রাসায় শিক্ষকতা, মসজিদের ইমামতি কিংবা খতিবের দায়িত্বে নিয়োজিত হন। কেউ কেউ ইসলামিক গবেষণা কেন্দ্র, দাওয়াতি কাজ বা সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন। তাদের মধ্যে অনেকেই নিজের উদ্যোগে ব্যবসা-বাণিজ্যেও নামেন—বিশেষ করে ইসলামিক বই প্রকাশনা বা ইসলামী শিক্ষাসংশ্লিষ্ট পেশায়। সরকারি চাকরিতে অংশগ্রহণ কম হলেও এসব ক্ষেত্র তাদের আত্মনির্ভরশীল করে তোলে। এছাড়া দাওরায়ে হাদিস শেষে অনেক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষায় প্রবেশ করে বিশেষ করে কোরআন, হাদিস, ফিকহ বা ইসলামী দর্শনের মতো বিষয়ে এমফিল বা পিএইচডি করে। তাদের কেউ দেশে থেকে গবেষণা করে, আবার কেউ কেউ বিদেশে—বিশেষ করে মালয়েশিয়া, মিসর, সৌদি আরব বা কাতার ইত্যাদি দেশে গমন করে উচ্চতর ডিগ্রির জন্য। তবে বিদেশে গিয়ে পিএইচডি বা গবেষণায় যুক্ত হওয়ার সংখ্যা এখনো তুলনামূলকভাবে কম, যদিও ধীরে ধীরে তা বাড়ছে।’

চাকরির পাশাপাশি বিভিন্ন পেশাগত প্রশিক্ষণ ও বিশেষায়িত পেশায়ও মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে আছে। ইনস্টি‌টিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএমএবি) প্রেসিডেন্ট এবং বিল্ডকন কনসাল‌টে‌ন্সিস লি‌মিটেডের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা প‌রিচালক মাহতাব উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠান সব ধারার শিক্ষার্থীদের জন্যই উন্মুক্ত। কিন্তু আমাদের এখানে যারা আছেন তারা বেশির ভাগই সাধারণ শিক্ষাধারার এবং মাদ্রাসা গ্র্যাজুয়েটের সংখ্যা খুব কম। এমন নয় যে আমাদের পরীক্ষাগুলো খুব কঠিন। শেখার আগ্রহ থাকলে এবং মনোযোগী হলে সহজেই দক্ষতা অর্জন সম্ভব। কিন্তু তবুও এখানে মাদ্রাসা গ্র্যাজুয়েটরা আসেন না বললেই চলে।’

শেয়ার করুনঃ