আল্লাহতায়ালা মাহে রমজানকে মুসলমানদের জন্য ইবাদতের বিশেষ মৌসুম হিসেবে মনোনীত করেছেন। এ মাসে ইবাদত করার সওয়াবকে অন্য মাসগুলোর চেয়ে বহুগুণ বৃদ্ধি করেছেন। এই মহান মাসে রয়েছে মর্যাদাবান শেষ দশক। শেষ দশকে রয়েছে সম্মানিত লাইলাতুল কদর। যে রাতের ইবাদত হাজার রাতের ইবাদতের চেয়ে উত্তম। তাই এ মহান মাসের প্রতিটি মুহূর্তকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো একজন মুসলিমের অনিবার্য কর্তব্য। এর জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু সুপরিকল্পনা এবং এর সঠিক বাস্তবায়ন। এই মোবারকপূর্ণ মাসে একজন মুসলিমের জন্য প্রস্তাবিত রুটিন-
সাহরি ও সকালের আমল
একজন মুসলিম ফজরের আগে ‘সাহরি’ খাওয়ার মাধ্যমে তার দিন শুরু করবেন। রাতের শেষ প্রহরে সাহরি গ্রহণ করা উত্তম। আজানের আগেই ফজরের নামাজের জন্য প্রস্তুতি নেবেন। বাসা থেকে অজু করে আজানের আগেই মসজিদে চলে যাবেন। এরপর মুয়াজ্জিন আজান দেওয়ার আগ পর্যন্ত বসে বসে দোয়া-দরুদ, কোরআন তিলাওয়াত বা জিকির-আজকারে মশগুল থাকবেন। আজান দিলে মুয়াজ্জিনের সঙ্গে সঙ্গে আজানের বাক্যগুলো পুনরাবৃত্তি করার মাধ্যমে ‘আজানের জবাব’ দেবেন। আজান শেষ হলে নবী করিম (সা.) থেকে বর্ণিত দোয়া পড়বেন। এরপর ‘ফজরের দুই রাকাত সুন্নত’ নামাজ আদায় করবেন। তারপর ফরজ নামাজ দাঁড়ানোর আগ পর্যন্ত জিকির, দোয়া ও কোরআন তিলাওয়াতে মগ্ন থাকবেন। হাদিসে এসেছে, ‘তোমাদের কেউ যতক্ষণ পর্যন্ত নামাজের জন্য অপেক্ষমাণ থাকে, ততক্ষণ সে নামাজেই থাকে।’ [বোখারি : ৬৪৭; মুসলিম : ৬৪৯]
জামাতের সঙ্গে সালাত আদায় শেষ হলে, সালাম ফেরানোর পর হাদিসে উদ্ধৃত ‘নামাজান্তে পঠিতব্য দোয়াগুলো’ পাঠ করবেন। এরপর ‘সকালের জিকিরগুলো’ পড়বেন। তারপর যার পক্ষে সম্ভব সূর্যোদয় পর্যন্ত মসজিদে অবস্থান করে জিকির ও কোরআন তিলাওয়াতে ব্যস্ত থাকবেন। নবী করিম (সা.) ফজরের পর এভাবে আমল করতেন। তারপর সূর্যোদয়ের পর সূর্য কিছুটা ওপরে উঠলে এবং উদয়ের পর ১৫ মিনিটের মতো অতিক্রান্ত হলে ইশরাকের নামাজ (সর্বনিম্ন দুই রাকাত) আদায় করে নিতে পারেন। আর চাইলে কিছুটা বিলম্বে দোয়া বা চাশতের নামাজটি পড়তে পারেন। উত্তম সময় হলোÑসূর্য আরো উপরে ওঠা ও রোদের প্রখরতা বাড়ার পর নামাজটি পড়া।
কর্মস্থলে যাওয়া, বৈষয়িক কাজকর্ম ও জোহরের আমল
এরপর কর্মস্থলে যাওয়ার আগে যদি কিছু সময় ঘুমাতে চান, তাহলে এ ঘুমের মাধ্যমে ইবাদত ও রিজিক অন্বেষণের জন্য শক্তি অর্জনের নিয়ত করবেন। যাতে করে এ ঘুমের মাধ্যমেও সওয়াব পেতে পারেন, ইনশাআল্লাহ। ইসলামি শরিয়ত যেসব কথা ও কাজকে ঘুমের আদব হিসেবে নির্ধারণ করেছে, সেগুলো পালনে যত্নবান হবেন।
এরপর নিজ কর্মস্থলে যাবেন। জোহরের নামাজের ওয়াক্ত কাছাকাছি এলে শিগগিরই আজানের আগে অথবা আজানের পরপরই মসজিদে হাজির হবেন। নামাজের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে থাকবেন। মসজিদে পৌঁছে ফরজ নামাজের আগে ‘জোহরের চার রাকাত সুন্নত’ নামাজ আদায় করবেন। তারপর কোরআন তিলাওয়াতে মনোনিবেশ করবেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না জামাত শুরু হয়। এরপর জামাতের সঙ্গে ফরজ নামাজ আদায় করবেন। ফরজ নামাজের পর ‘জোহরের দুই রাকাত সুন্নত নামাজ’ আদায় করবেন। নামাজ আদায় শেষে ডিউটির বাকি অংশ সম্পন্ন করবেন। ডিউটি শেষে বাসায় ফিরে আসবেন।
ঘরে ফেরা এবং আসরের নামাজ
কর্মস্থল থেকে ফিরে আসার পর আসরের নামাজের আগে যদি ঘুমানোর মতো সময় থাকে, তাহলে কিছু সময় ঘুমিয়ে নেবেন। এ ঘুমের মাধ্যমে কিয়ামুল লাইল বা তারাবির নামাজের জন্য শক্তি অর্জনের নিয়ত করবেন। আর যদি ঘুমিয়ে পড়লে আসরের নামাজ ছুটে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাহলে নামাজের ওয়াক্ত হওয়া পর্যন্ত প্রয়োজনীয় কোনো কাজে ব্যস্ত থাকবেন। আসরের আজানের আগেই মসজিদে চলে যাবেন এবং কোরআন তিলাওয়াত ও জিকিরে মশগুল থাকবেন। খুশুখুজুর সঙ্গে ‘আসরের নামাজ’ জামাতের সঙ্গে আদায় করবেন। এরপর ‘সন্ধ্যার জিকিরগুলো’ পড়বেন। তারপর প্রয়োজনীয় বাজার-সদাই সেরে দ্রুত বাসায় ফিরে আসবেন।
ইফতারের প্রস্তুতি ও মাগরিবের নামাজ
মাগরিবের আজানের আগে ইফতারের জন্য প্রস্তুতি নেবেন। এই মুহূর্তগুলো তিনি যেকোনো ভালো কাজে ব্যয় করবেন। যেমন : কোরআন তিলাওয়াত করা, দোয়া করা অথবা পরিবার ও সন্তানদের নিয়ে ভালো কোনো বিষয়ে আলোচনা করা। এ সময়ের সবচেয়ে ভালো কাজ হলোÑ ‘রোজাদারদের ইফতার করানোতে’ অংশ নেওয়া। হয়তো তাদের জন্য খাবার কিনে দেওয়ার মাধ্যমে অথবা তা বিতরণ করার মাধ্যমে অথবা এর ব্যবস্থাপনা করার মাধ্যমে। হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো রোজাদারকে ইফতার করাবেন, তিনি রোজাদারের সমান সওয়াব পাবেন। রোজাদারের সওয়াবে কোনো কমতি করা হবে না।’ [সুনানে তিরমিজি]
সামান্য ইফতার করেই তিনি জামাতের সঙ্গে ‘মাগরিবের নামাজ’ আদায় করার উদ্দেশ্যে মসজিদে চলে আসবেন। মাগরিবের ফরজ নামাজ আদায় করার পর ‘মাগরিবের দুই রাকাত সুন্নত’ নামাজ আদায় করবেন। এরপর বাসায় ফিরে প্রয়োজনমাফিক খাদ্য গ্রহণ করবেন। অতিরিক্ত খাবেন না। হাদিসে এসেছে, ‘বনী আদম পেটের চেয়ে নিকৃষ্ট কোনো পাত্রকে ভর্তি করেনি। তার জন্য এতটুকু খাওয়াই যথেষ্ট যতটুকু তার পিঠকে সোজা রাখবে।’ [সুনানে তিরমিজি]
এশা ও তারাবির নামাজ
এরপর এশার আগ পর্যন্ত সময়কে তার নিজের জন্য ও তার পরিবারের জন্য কল্যাণকর কোনো কাজে ব্যয় করবেন। যেমন : কোনো নবীদের কাহিনি পড়া, প্রয়োজনীয় হুকুম-আহকামের বই পড়া, বৈধ কোনো আলাপ-আলোচনায় রত থাকা। তারাবির জন্য প্রস্তুতি হিসেবে হালকা একটু বিশ্রামও নিতে পারেন।
এরপর আজানের আগেই এশার নামাজের জন্য প্রস্তুতি নিন এবং মসজিদের উদ্দেশে রওনা হন। মসজিদে গিয়ে কোরআন তিলাওয়াতে মশগুল হন। অথবা মসজিদে কোনো ইলমি আলোচনা অনুষ্ঠান থাকলে তা শুনুন। এরপর ‘এশার নামাজ’ আদায় করুন। অতঃপর দুই রাকাত ‘এশার সুন্নত নামাজ’ আদায় করুন। এরপর ইমামের পেছনে তারাবির নামাজ খুশু (আল্লাহর ভয়), তাদাব্বুর (অনুধাবন), তাফাক্কুরের (চিন্তাভাবনা) সঙ্গে আদায় করুন। ইমাম যত রাকাত তারাবির নামাজ পড়েন, ইমামের সঙ্গে তত রাকাত নামাজ পড়ুন। তাহলে আপনি পুরো রাত ইবাদত করার সওয়াব পাবেন মর্মে হাদিসে সাব্যস্ত হয়েছে।
দিনের সমাপ্তি ও রাতের নিদ্রা
তারাবির নামাজের পর অবিলম্বে ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করুন। শেষ রাতে আগে আগে জেগে উঠুন। সাহরি খাওয়ার আগে ‘তাহাজ্জুদ নামাজ’ আদায় করুন এবং ‘দোয়া’ করুন। রাতের শেষ তৃতীয়াংশ দোয়া কবুলের উপযুক্ত সময়। তাই দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ প্রার্থনা করে আল্লাহর কাছে দোয়া করুন। হেদায়েতের ওপর অটল ও অবিচল থাকার প্রার্থনা একজন দোয়াকারীর দোয়ায় প্রাধান্য পাওয়া বাঞ্ছনীয়। আল্লাহতায়ালা সবাইকে তাওফিক দিন।