শিশুরা সমাজের শ্রেষ্ঠ সম্পদ, জাতির সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ। একটি শিশু যখন স্নেহ ও ভালোবাসাপূর্ণ পরিবেশে বেড়ে ওঠে, তখন সে কেবল একজন সুস্থ ব্যক্তিত্বে পরিণত হয় না, বরং আগামী দিনের সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের জন্য হয়ে ওঠে এক মূল্যবান অংশীদার। ইসলামে শিশুদের অধিকারকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন স্নেহ, দয়া ও মানবতার জীবন্ত প্রতীক। তার ব্যক্তিত্বের এক অনন্য দিক ছিল শিশুদের প্রতি গভীর ভালোবাসা, অকৃত্রিম স্নেহ ও হৃদয় ছোঁয়া সহানুভূতি।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর এই শিশুপ্রীতি কোনো আনুষ্ঠানিকতার আবরণে ঢাকা ছিল না, বরং তা ছিল তার হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত প্রকৃত মমতা। তিনি কেবল নিজের সন্তান কিংবা নাতিনাতনিদের ভালোবাসতেন না, বরং প্রতিটি শিশুর প্রতিই ছিল তার স্নেহশীল আচরণ এবং বন্ধুসুলভ ব্যবহার। তিনি শিশুদের কোলে নিতেন, চুমু দিতেন, তাদের জন্য দোয়া করতেন, এমনকি নামাজের সময়ও নাতনিকে কাঁধে তুলে রাখতেন। এই মমত্ববোধ ছিল একটি উদাহরণস্বরূপ চারিত্রিক গুণ, যা তিনি তার উম্মতকে নিজের জীবনের মাধ্যমে শিখিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘যে ছোটদের প্রতি স্নেহ প্রদর্শন করে না এবং বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান করে না, সে আমার উম্মত নয়।’ তার এই বক্তব্যে স্পষ্ট যে, শিশুর প্রতি স্নেহ ও বড়দের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ইসলামি নৈতিকতার মৌলিক অংশ। তার দয়ার পরিধি শুধু মুসলিম শিশুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং অমুসলিম বালক, দাস-সন্তান কিংবা প্রান্তিক পরিবারের শিশুর প্রতিও ছিল তার অকুণ্ঠ ভালোবাসা।
এই প্রবন্ধে নবীজি (সা.)-এর স্নেহধন্য ১০ শিশুর কাহিনি তুলে ধরা হয়েছে, যাদের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ, আর আচরণ ছিল উদার ও প্রেরণাময়। এসব ঘটনা নিছক ঐতিহাসিক তথ্য নয়, বরং জীবন্ত আদর্শ, যা প্রতিটি অভিভাবক ও সমাজের দায়িত্বশীল মানুষের হৃদয়ে গেঁথে নেওয়া জরুরি। আজকের বিশ্বে, যেখানে শিশুরা নানা নির্যাতন ও অবহেলার শিকার, সেখানে নবীজি (সা.)-এর জীবনচিত্র আমাদের সামনে মানবিকতা ও ন্যায়বোধের এক চিরন্তন দিশা হিসেবে উপস্থিত হয়।
এক. নবীজি (সা.)-এর শিশুপুত্র ইব্রাহিমের প্রতি তার স্নেহ ও মমতা সম্পর্কে আনাস বিন মালিক (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ছেলে ইব্রাহিম মদিনার গ্রামাঞ্চলে দুধ পান করতেন। রাসুল (সা.) তাকে দেখতে সেখানে যেতেন। আমরাও তার সঙ্গে যেতাম। তিনি ইব্রাহিমের দুধ মায়ের ঘরে ঢুকতেন আর সেখানে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন থাকত। কেননা তার দুধপিতা কর্মকার (কামার) ছিল। তিনি ছেলেকে কোলে তুলে চুমু খেতেন। পরে তিনি প্রত্যাবর্তন করতেন। (সহিহ মুসলিম)
দুই. হজরত ফাতেমা (রা.)-এর ছেলে হাসান (রা.) ছিলেন নবীজি (সা.)-এর অত্যন্ত প্রিয়। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, একদিন নবী করিম (সা.) বনু কায়নুকা বাজারে এলেন, (সেখান থেকে ফিরে এসে) ফাতেমা (রা.)-এর ঘরের আঙিনায় বসে পড়লেন। তারপর বললেন, এখানে খোকা (হাসান) আছে কি? এখানে খোকা আছে কি? ফাতেমা (রা.) তাকে কিছুক্ষণ দেরি করালেন। আমার ধারণা হলো, তিনি তাকে পুঁতির মালা (সোনা-রুপা ছাড়া যা বাচ্চাদের পরানো হতো) পরাচ্ছিলেন। তারপর তিনি দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলেন এবং চুমু খেলেন। তখন তিনি বললেন, হে আল্লাহ! তুমি তাকে (হাসানকে) মহব্বত কর এবং তাকে যে ভালোবাসবে তাকেও মহব্বত কর। (সহিহ বুখারি)
তিন. ফাতেমা (রা.)-এর অন্য পুত্র হুসাইন (রা.)-ও নবীজি (সা.)-এর স্নেহধন্য ছিলেন। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) একবার হুসাইন (রা.)-কে চুম্বন করেন। সে সময় তার কাছে আকরা বিন হাবিস তামিমি (রা.) বসে ছিলেন। আকরা বিন হাবিস (রা.) বললেন, আমার ১০টি পুত্র আছে, আমি তাদের কাউকেই কোনো দিন চুম্বন করিনি। রাসুলুল্লাহ (সা.) তার দিকে তাকিয়ে বললেন, যে দয়া করে না, সে দয়া পায় না। (সহিহ্ বুখারি)
চার. সাহাবায়ে কেরাম (রা.)-এর অভ্যাস ছিল সন্তান হলে তারা নবীজি (সা.)-এর কাছে নিয়ে আসতেন। নবীজি (সা.) শিশুকে চুমু খেতেন, তাহনিক করতেন (মুখে খাবার চিবিয়ে খাওয়ানো), শিশুর জন্য বরকতের দোয়া করতেন, কখনো কখনো নাম রাখতেন। এমনই সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন আবু মুসা আশআরি (রা.)-এর বড় ছেলে ইব্রাহিম। তিনি বলেন, আমার একটি পুত্রসন্তান জন্মালে আমি তাকে নিয়ে নবী করিম (সা.)-এর কাছে গেলাম। তিনি তার নাম রাখলেন ইব্রাহিম। তারপর খেজুর চিবিয়ে তার মুখে দিলেন এবং তার জন্য বরকতের দোয়া করেন। অতঃপর তাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিলেন।’ (সহিহ বুখারি)
পাঁচ. আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের (রা.)-এর মা আসমা বিনতে আবু বকর (রা.) বলেন, গর্ভকাল পূর্ণ হওয়া অবস্থায় আমি মক্কা থেকে মদিনায় এলাম এবং কুবায় অবতরণ করলাম। কুবায়ই আমি আবদুল্লাহকে প্রসব করি। তারপর তাকে নিয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে তাকে তার কোলে রাখলাম। তিনি একটি খেজুর আনতে বললেন। তা চিবিয়ে তিনি তার মুখে দিলেন। রাসুল (সা.)-এর এই খাবারই সর্বপ্রথম তার পেটে প্রবেশ করেছিল। তারপর তিনি খেজুর চিবিয়ে তাহনিক করলেন এবং তার জন্য বরকতের দোয়া করলেন। (সহিহ বুখারি)
ছয়. উম্মু খালিদ (রা.) ছিলেন খালিদ ইবনে সাইদ ইবনে আস (রা.)-এর কন্যা। তার মা-বাবা উভয়ে হাবশায় হিজরত করেন এবং সেখানেই তার জন্ম হয়েছিল। মদিনায় আসার পর নবীজি (সা.) তাকে নতুন কাপড় উপহার দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে কিছু কাপড় নিয়ে আসা হয়। তার মধ্যে কিছু কালো নকশিদার ছোট চাদর ছিল। তিনি বললেন, আমরা এগুলো পরব, তোমাদের মত কী? উপস্থিত সবাই চুপ থাকল। তারপর তিনি বললেন, উম্মু খালিদকে আমার কাছে নিয়ে এসো। তাকে বহন করে আনা হলো। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজের হাতে একটি চাদর নিলেন এবং তাকে পরিয়ে দিলেন। তিনি বললেন, এটি তুমি পুরাতন করো এবং ছিঁড়ে ফেলো (তুমি বহুদিন বাঁচো)। নবীজি (সা.) বললেন, উম্মে খালিদ! এটি কত সুন্দর! (সহিহ বুখরি)
সাত. উমামা বিনতে আবুল আস (রা.) ছিলেন মহানবী (সা.)-এর নাতনি। তার প্রতিও নবীজি (সা.) অত্যন্ত স্নেহশীল ছিলেন। আবু কাতাদা আনসারি (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল (সা.) তার মেয়ে জয়নবের গর্ভজাত ও আবুল আস (রা.)-এর ঔরসজাত কন্যা উমামা (রা.)-কে কাঁধে নিয়ে নামাজ আদায় করতেন। তিনি যখন সেজদায় যেতেন তখন তাকে রেখে দিতেন আর যখন দাঁড়াতেন তখন তাকে তুলে নিতেন। (সহিহ বুখারি)
আট. আনাস ইবনে মালিক (রা.) বলেন, এক ইহুদি বালক নবী করিম (সা.)-এর সেবা করত, সে একবার অসুস্থ হয়ে পড়লে নবী করিম (সা.) তাকে দেখতে যান। তিনি তার মাথার কাছে বসলেন এবং বললেন, তুমি ইসলাম গ্রহণ করো, সে তখন তার পিতার দিকে তাকাল, সে তার কাছেই ছিল। পিতা তাকে বলল, আবুল কাসেমের কথা মেনে নাও, তখন সে ইসলাম গ্রহণ করল। নবী করিম (সা.) সেখান থেকে বের হওয়ার সময় বললেন, সব প্রশংসা সেই আল্লাহর, যিনি তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিলেন। (সহিহ বুখারি)
নয়. বিখ্যাত সাহাবি আনাস (রা.)-এর ভাই আবু উমায়ের (রা.)। নবীজি (সা.) তাদের দুই ভাইয়ের প্রতি স্নেহপরায়ণ ছিলেন। আনাস ইবনে মালিক (রা.) বলেন, নবী করিম (সা.) আমাদের সঙ্গে আন্তরিকভাবে মেলামেশা করতেন, এমনকি তিনি আমার এক ছোট ভাইকে জিজ্ঞাসা করতেন, হে আবু উমায়ের! কেমন আছে তোমার নুগায়ের? (সহিহ বুখারি)
দশ. আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) একটি সেনাদল প্রেরণ করেন এবং উসামা বিন জায়েদ (রা.)-কে তাদের সেনাপতি নিযুক্ত করেন। তখন কোনো কোনো সাহাবি (সম্ভবত বয়স কম হওয়ায়) তার নেতৃত্বের সমালোচনা করেন। এতে রাসুলুল্লাহ (সা.) দাঁড়ালেন এবং বললেন, তোমরা আজ তার নেতৃত্বের সমালোচনা করছ, এভাবে তোমরা তার পিতা জায়েদের নেতৃত্বের সমালোচনা করত। আল্লাহর কসম! সে (জায়েদ) ছিল নেতৃত্বের জন্য যোগ্য ব্যক্তি এবং আর সে আমার কাছে লোকদের মধ্যে প্রিয়তম ব্যক্তি। আর এ উসামা লোকদের মধ্যে আমার কাছে প্রিয়তম ব্যক্তি। (সহিহ বুখারি)