
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে পথ চলবে বিএনপি। এ জন্য আগামী জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত এ সরকারের সঙ্গে যেন কোনোভাবে দূরত্ব তৈরি না হয়, সে বিষয়ে সতর্ক থাকবে দলটি। পাশাপাশি বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা এও বলছেন যে, যৌক্তিক সময়ে ভোটের আয়োজন করা না হলে নির্বাচনের দাবিতে রাজপথে থেকে সরকারের ওপর চাপ তৈরি করা হবে।
সম্প্রতি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও বলেছেন, বিএনপি মনে করে কোনোভাবেই অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। কারণ এ সরকারের ব্যর্থতা হবে গণতন্ত্রের ও বাংলাদেশের পক্ষের শক্তির ব্যর্থতা।
অন্তর্বর্তী সরকারকে কেউ যেন ব্যর্থ করতে না পারে, সে জন্য আগামী ৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবসের দিন থেকেই নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকবে দলটি। এ সময় ঢাকা মহানগরসহ তৃণমূলকে শক্তিশালী করতে সাংগঠনিক পুনর্গঠন কার্যক্রম পরিচালনা করবে বিএনপি। একই সঙ্গে নির্বাচনী কার্যক্রমও দৃশ্যমান করবে। পাশাপাশি গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এবং সর্বশেষ জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার সফল অভ্যুত্থানে ভূমিকা রাখা ছাত্র ও রাজনৈতিক শক্তির ঐক্য ধরে রাখার চেষ্টাও অব্যাহত রাখবে দলটি।
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ^রচন্দ্র রায় বলেন, আমরা অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্বাচন আয়োজনের জন্য যৌক্তিক সময় দিতে চাই। আমরা আশা করি, সরকার এই সময়কে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে সংস্কারকাজ শেষ করে দ্রুত নির্বাচন দেবে।
বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা বলছেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে পদত্যাগ করে দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে গিয়ে অবস্থান নেওয়া শেখ হাসিনা সেখানে বসেই নানা যড়যন্ত্র করছেন। বিভিন্ন ব্যানারে পতিত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা রাজপথে নামছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- আনসারদের সচিবালয় ঘেরাও এবং চলমান গার্মেন্টস শিল্পে অস্থিরতা তৈরি। যেহেতু ইউনূস সরকার মানবিক দিক বিবেচনা করে কঠোর হচ্ছে না, সেই সুযোগটাই আওয়ামী লীগ বারবার কাজে লাগাতে চাইছে।
বিএনপির নেতারা আরও বলেন, সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর মিরপুরের-১৪ নম্বর সেক্টরের কচুক্ষেত এলাকায় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর গাড়িতে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। বিএনপি মনে করে, গার্মেন্ট শ্রমিকদের অসন্তোষকে কাজে লাগিয়েই মূলত আওয়ামী লীগ দেশকে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিতে ঠেলে দিতে চাইছে। জাতীয় পার্টির সাম্প্রতিক ভূমিকাকেও সন্দেহের চোখে দেখছে বিএনপি। সনাতন জাগরণ মঞ্চের ব্যানারে হিন্দু সম্প্রদায়ের চট্টগ্রামের কার্যক্রমকেও ভালোভাবে দেখছে না দলটি।
গত বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ইদানীং
দেখছি একটা সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে বড় রকমের আন্দোলন সৃষ্টি করার চেষ্টা চলছে। কেন জানি না, ভারতের যে বক্তব্য বাংলাদেশের বিপদ সম্পর্কে, তা এ আন্দোলনের সঙ্গে মিলে যায়। বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার রক্ত দিয়ে যে অর্জন এসেছে, তা অনেকাংশে বিপন্নœ করার চেষ্টা চলছে।
গতকাল প্রায় একই ধরনের বক্তব্য রেখেছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, আমাদের দেশের আকাশে সাড়ে ১৫ বছর কালো মেঘের ছায়া ছিল। মেঘ কেটে যায়নি। আমরা সবাই সচেতন নাগরিক হিসেবে এটা টের পাচ্ছি। এ সময় জাতীয় ঐক্যের বড়-ই প্রয়োজন।
বিএনপি সূত্রে জানা যায়, পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের ঐক্য ও সাংগঠনিক শক্তি বাড়ানোর দিকে নজর দিচ্ছে বিএনপি। নির্বাচনের আগ পর্যন্ত রাজধানী ঢাকাসহ তৃণমূলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে পুনর্গঠনের কাজে হাত দেবে দলটি। ইতোমধ্যেই দলের কেন্দ্র থেকে জেলা ও মহানগরের বর্তমান কমিটির মেয়াদ ও নেতাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ শুরু হয়েছে। বিএনপির এক সাংগঠনিক সম্পাদক জানান, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশে আমরা কমিটির তথ্য সংগ্রহের কাজ করছি। যে সব কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে, সেখানে কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন কমিটি হবে। নিষ্ক্রিয় নেতারা এবং নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িতরা নতুন কমিটিতে স্থান পাবেন না।
সূত্রমতে, ইতোমধ্যে তিনটি জেলা কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। নেতারা বলছেন, বিএনপির সুদিনের সম্ভাবনায় এখন অনেক হাইব্রিড নেতা জুটতে শুরু করেছে, আওয়ামী লীগের অনেক সুবিধাভোগী খোলস পরিবর্তন করে বিএনপির রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে চাইছে। এ বিষয়ে বিএনপির পক্ষ থেকে কঠোর নির্দেশনা থাকলেও বিভিন্ন কায়দা-কানুন করে দলের দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে আখের গোছানোর চেষ্টা করছেন কেউ কেউ। তারা এমন তথ্যই পেয়েছেন। আবার অনেকে আছেন, যারা বিগত দিনে আন্দোলন-সংগ্রামে মাঠে ছিলেন না। পটপরিবর্তনের পর তারাও এখন নানা জায়গায় প্রভাব খাটাচ্ছেন। যে কারণে ক্ষেত্রবিশেষে কোণঠাসা বিএনপির ত্যাগী নেতারা। দায়িত্বশীল নেতারা জানান, আন্দোলন-সংগ্রামে থাকা ত্যাগীদের মূল্যায়ন করতেই কাজ করছেন তারা।
সূত্রমতে, পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের ঐক্য ধরে রাখতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে ধারাবাহিক বৈঠক অব্যাহত রেখেছে বিএনপি। ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, গণফোরাম, গণঅধিকার পরিষদ, এনডিএমসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ইতোমধ্যে বৈঠক করেছেন বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির নেতারা। যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত রাজনৈতিক দলের নেতারা বলেন, এ বৈঠকের একটাই বার্তা হচ্ছে, যে কোনোভাবে গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হয়েছে, জনগণের ভোটে ক্ষমতায় গেলে জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করা হবে। কোনো অবস্থাতেই যুগপৎ আন্দোলনের নেতাদের মাঝে যেন কোনো বিভেদ সৃষ্টি না হয়, সে ব্যাপারে সবাইকে সজাগ থাকারও বার্তা দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, যুগপৎ আন্দেলনের নেতারা যাতে এলাকায় নির্বিঘেœ সাংগঠনিক কার্যক্রম করতে পারেন, সে জন্য ছয় নেতাকে সহযোগিতা করতে স্থানীয় নেতাদের কাছে চিঠিও দেওয়া হয়েছে। এই চিঠি পাওয়ার পর গণঅধিকার পরিষদের নুরুল হক নুর পটুয়াখালীতে বড় ধরনের সমাবেশও করেছেন।
বিএনপি নেতারা বলেন, সমমনা রাজনৈতিক দল ও ছাত্র শক্তির মাঝে যাতে কোনো বিভেদ সৃষ্টি না হয়, সে ব্যাপারে তারা সতর্ক আছেন। রাষ্ট্রপতির অপসারণ ইস্যুটি নিয়ে একটি গোষ্ঠী বিভেদ তৈরির চেষ্টা করেছিল। তারা মনে করছেন, সেই বিভেদ তারা সফলভাবেই কাটিয়ে উঠেছেন।
বিএনপি নেতারা জানান, পরিস্থিতি বিবেচনায় রাজপথ শূন্য না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। সম্প্রতি জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা শেষে মাঠে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। এরই অংশ হিসেবে আগামী ৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে ইতোমধ্যে ঢাকাসহ সারাদেশে ১০ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। এর মধ্যে আগামী ৮ নভেম্বর রাজধানীতে ঢাকা বিভাগের সব জেলা ও মহানগর নেতাদের জমায়েত করে বড় ধরনের শোভাযাত্রা করবে দলটি। এই নিয়ে ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা।
দলের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক নেতা বলেন, জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবসের ঘোষিত কর্মসূচির পর নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। সেখানে রাষ্ট্র মেরামতে দলের ৩১ দফার পক্ষে জনমত গঠন, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের দাবিতে নানা কর্মসূচি করবে দলটি। দলীয় সূত্রে জানা যায়, এসব কর্মসূচির মাধ্যমে সম্ভাব্য প্রার্থীদের কার কী জনপ্রিয়তা এলাকায় আছে, তার একটা চিত্রও পাওয়া যাবে। এর মধ্য দিয়ে নির্বাচনের একটি কার্যক্রম দৃশ্যমান হবে বলে মনে করেন দলের নীতিনির্ধারণী ফোরামের নেতারা।