
মে দিবস। বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ের ঐতিহাসিক দিন আজ। শ্রমিকদের আত্মত্যাগের দিনটি সারা বিশ্বে একযোগে ‘মহান মে দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে। দিনটি শ্রমজীবী মানুষের জয়গান গাওয়ার। সংস্কৃতি অঙ্গনেও বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন ভাষায় শ্রমিকশ্রেণিকে নিয়ে তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্র। বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে সরাসরি মে দিবস বা শ্রমিকদের উপলক্ষ করে কোনো চলচ্চিত্র দেখা যায় না। তবে অধিকাংশ ছবিতেই শ্রম বৈষম্য, ধনিক শ্রেণির হাতে শ্রমজীবী গরিবের বঞ্চনা-বিভেদ খুঁজে পাওয়া যায়। অনেক ছবিতেই খেটে খাওয়া মানুষের হাহাকার, অধিকার আদায়ের গল্প ফুটে উঠেছে। সেই সবের ভিড়ে কিছু চলচ্চিত্র কালজয়ী হয়ে আছে।
ঢালিউড
এর মধ্যে অন্যতম ‘ভাত দে’। আমজাদ হোসেন পরিচালিত এ ছবিতে জুটি বেঁধে অভিনয় করেন আলমগীর ও শাবানা। ছবিতে দেখানো হয়, অকালে বাবা হারানো জরি চরিত্রে শাবানার বেঁচে থাকার সংগ্রাম। বাউল স্বামীর সংসারে অভাবের তাড়নায় অন্যের বাড়িতে শ্রম বেচে জীবন ধারণ করেন তিনি। কিন্তু কাজের মধ্যে নানা প্রতিকূলতার মুখে পড়তে হয়। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৮৪ সালে।
বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত জনপ্রিয় উপন্যাস থেকে নির্মাণ করা ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ ছবিটি। নির্মাণ করেন গৌতম ঘোষ। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ প্রযোজিত এ ছবিতে অভিনয় করেন রাইসুল ইসলাম আসাদ, চম্পা, রূপা ব্যানার্জী, উৎপল দত্তসহ অনেকে। ছবিটিকে প্রান্তিক মানুষের জীবনযাপন নিয়ে অনবদ্য এক নির্মাণ বলে মনে করা হয়। এখানে শ্রমিক হিসেবে অন্যের নৌকায় মাছ ধরে বেড়ানো কুবেরসহ সকল মাঝির বঞ্চিত হওয়ার গল্প ফুটে উঠেছে। আছে জোতদার নিষ্ঠুর মালিক চরিত্ররা। ছবিটি দর্শকের হৃদয় ছুঁয়ে যায় খুব সহজেই।
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের জীবন সংগ্রামের গল্পে নির্মিত হয়েছে ‘সারেং বউ’ ছবিটি। পরিচালনা করেন আবদুল্লাহ আল মামুন। বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেন ফারুক, কবরী, আরিফুল হক, জহিরুল হক, বিলকিস, বুলবুল ইসলাম, ডলি চৌধুরীসহ অনেকে। খেটে খাওয়া মানুষরা দিনের পর দিন কেমন করে গ্রামের প্রভাবশালী মোড়লদের দ্বারা শোষিত হয়েছে- সেটাই ছবিতে ফুটে উঠেছে । এতে আবদুল জব্বারের গাওয়া ‘ওরে নীল দরিয়া’ গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এ ছাড়াও ‘আন্ডার কনস্ট্রাকশন’, ‘শিমু’, ‘কাজের বেটি রহিমা’, ‘শ্রমিক নেতা’, ‘বিদ্রোহী গার্মেন্টস কন্যা’সহ আরও অনেক ছবিতেই নানাভাবে বলা হয়েছে মেহনতি মানুষের গল্প।
বলিউড
শ্রমিকদের জীবনের গল্প নিয়ে বলিউডেও একাধিক সিনেমা নির্মিত হয়েছে। ১৯৫৭ সালে মুক্তি পায় বি আর চোপড়া পরিচালিত ‘নয়া দৌড়’ ছবিটি। দীলিপ কুমার অভিনীত এ ছবিতে উঠে এসেছে ঘোড়ার গাড়ির গাড়োয়ানদের গল্প। এখানে নায়িকা ছিলেন বৈজয়ন্তীমালা। মিল-কারখানার শ্রমিকদের গল্প নিয়ে নির্মিত ‘মজদুর’ মুক্তি পায় ১৯৮৩ সালে। রবি চোপড়া পরিচালিত ছবিটিতে অভিনয় করেন দীলিপ কুমার ও নান্দা। কয়লা খনির শ্রমিকদের জীবনচিত্র তুলে ধরা হয় ‘কালা পাহাড়’ ছবিতে। যশ চোপড়া পরিচালিত এ ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৭৯ সালে। এতে অভিনয় করেন অমিতাভ বচ্চন, শশী কাপুর, শত্রুঘœ সিনহা, রাখী, পারভিন ববি ও নীতু সিং। ছবিটি সেরা পরিচালক, সেরা অভিনেতা ও অভিনেত্রীসহ মোট ৯টি বিভাগে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার জিতে নেয়। ‘কয়লা’ ছবিতে অভিনয় করে দারুণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন শাহরুখ খান ও মাধুরী দীক্ষিত জুটি। ছবিটিকে বলিউডে শ্রমিকদের উজ্জীবিত করার সিনেমা হিসেবে অভিহিত করা হয়।
হলিউড
হলিউডের অনেক সিনেমায়ও শ্রমজীবী মানুষের জয়গান গাওয়া হয়েছে। যেগুলো দেখলে শুধু নান্দনিক খিদেই মেটে না, মনের মধ্যে কিছু প্রশ্নেরও জন্ম হয়। তেমনই এক সিনেমা ‘মেইটওয়ান’। ১৯২০ সালের এক কয়লাখনি নিয়ে এর কাহিনি। জন সেইলেসের পরিচালনায় এ ছবিতে অভিনয় করেন ক্রিস কুপার, জেমস আর্ল জোনস, ম্যারি ম্যাকডোনালসহ অনেকে। ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৮৭ সালে। সেরা চিত্রনাট্যের জন্য অস্কারে মনোনয়ন পায় ছবিটি। ১৯৭৯ সালে মুক্তি পায় পোশাককর্মী থেকে ইউনিয়নের নেতা হয়ে যাওয়া ক্রিস্টাল লি সুটনের জীবনের সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত ‘নরমা রে’ সিনেমাটি। পরিচালনা করেন মার্টিন রিট। নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন স্যালি ফিল্ড। ছবিতে অনবদ্য অভিনয়ের জন্য অস্কার জেতেন তিনি। ১৯৫৪ সালে মুক্তি পায় ‘অন দ্য ওয়াটারফ্রন্ট’ ছবিটি। এটি বারবার দেখার মতো সিনেমা। ইলিয়া কাজান পরিচালিত ছবিটির মূল আকর্ষণ মার্লোন ব্রান্ডোর অসাধারণ অভিনয়। আরও অভিনয় করেন কার্ল ম্যালডেন, লি জে কব প্রমুখ। ‘অন দ্য ওয়াটারফ্রন্ট’ অস্কারে ১২টি ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন পায়। এর মধ্যে সেরা ছবি, সেরা পরিচালক, সেরা অভিনেতা, পার্শ্বচরিত্রে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কারসহ আটটি পুরস্কার জোটে ছবিটির ভাগ্যে। ১৯৬৩ সালে মুক্তি পাওয়া ইতালি, ফ্রান্স এবং যুগোসøাভিয়ার যৌথ প্রযোজনার ‘দ্য অর্গানাইজার’ ছবিটি গল্প বলে এক পালিয়ে বেড়ানো অধ্যাপকের। যিনি ঘটনাচক্রে একটি শ্রমিক সংগঠনের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের নেতা বনে যান। সিনেমাটি আরও তুলে ধরে শ্রমিকদের বিপজ্জনক পরিবেশে দিনে ১৪ ঘণ্টা খাটুনির অমানবিক পরিস্থিতিকেও। মারিও মনচেল্লির পরিচালনায় ‘দ্য অর্গানাইজার’-এ প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন প্রখ্যাত ইতালীয় অভিনেতা মার্সেলো মাস্ত্রোয়ানি। সিনেমাটি সে বছর সেরা চিত্রনাট্যের জন্য মনোনীত হয় অস্কারে। ২০০০ সালে মুক্তি পাওয়া কেন লোচের ‘ব্রেড অ্যান্ড রোজেস’ ছবিতে পরিচ্ছন্নতা কর্মীদেরকে তাদের অধিকার আদায়ের জন্য এক হতে দেখা গেছে। সিনেমার গল্প মেক্সিকো থেকে আমেরিকার লসঅ্যাঞ্জেলেসে আসা দুই অভিবাসী বোনকে ঘিরে। কথায় কথায় কর্মীদের ছাঁটাই করা হয়। তারা এসবের প্রতিবাদ করে এবং অধিকার আদায়ের জন্য এক হয়।
এ ছাড়াও ‘হাউ গ্রিন ওয়াজ মাই ভ্যালি’ (১৯৪১), ‘নেটিভ ল্যান্ড’ (১৯৪২), ‘দ্য পাজামা গেম’ (১৯৫৭), ‘আই অ্যাম অল রাইট জ্যাক’ (১৯৫৯), ‘হারলান কাউন্টি’ (১৯৭৬) ছবিগুলোয় শ্রমিকদের আন্দোলন ও অধিকার আদায়ের গল্প উঠে এসেছে।