
মানবজীবনের প্রয়োজনীয়তা কেবল খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। এর বাইরেও রয়েছে চিত্তবিনোদন, মানসিক প্রশান্তি এবং শারীরিক বিকাশের প্রয়োজনীয়তা। জীবনের স্বাভাবিক গতি বজায় রাখতে খেলাধুলা ও শরীরচর্চা করা খুবই প্রয়োজন। ইতিহাসের পাতায় পাতায় আমরা দেখতে পাই, সভ্য জাতিগুলো কেবল বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষেই নয়, বরং ক্রীড়াচর্চায়ও ছিল সমান দক্ষ ও সচেতন। শারীরিক সক্ষমতা যেমন জাতির সামগ্রিক অগ্রগতির এক গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি, তেমনি তা মানসিক প্রশান্তি ও সামাজিক সৌহার্দ্য বৃদ্ধিরও একটি কার্যকর মাধ্যম।
ইসলাম জীবনব্যবস্থা হিসেবে মানবজীবনের প্রতিটি দিক বিবেচনায় নিয়েছে। কেবল ইবাদত বা ধর্মীয় রীতি নয়; বরং খেলাধুলা, বিনোদন, বিশ্রাম, শারীরিক প্রশিক্ষণসহ সব কিছুতেই ইসলামের সুস্পষ্ট নির্দেশনা বিদ্যমান। ইসলামের দৃষ্টিতে খেলাধুলা কোনো নিষিদ্ধ বিষয় নয়; বরং তা নির্দিষ্ট শর্ত ও সীমারেখায় থেকে পরিচালিত হলে প্রশংসনীয় এবং এ বিষয়ে উৎসাহিত করেছে ইসলাম। শরীরচর্চা ও শারীরিক সক্ষমতা অর্জনের উদ্দেশে খেলাধুলা করা ব্যক্তিজীবনে যেমন উপকারী, তেমনি ইসলামের পয়গাম প্রচারে এবং মুসলিম জাতির প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বৃদ্ধি করতেও সহায়ক। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজেই এর বহু দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন।
সাহাবিদের যুগে খেলাধুলা শুধু বিনোদনের মাধ্যম ছিল না; বরং তা এক ধরনের প্রশিক্ষণ, প্রস্তুতি ও শরীর-মন গঠনের মাধ্যম ছিল। হাদিস ও সিরাতের বিভিন্ন বর্ণনায় দেখা যায়, রাসুল (সা.) সাহাবিদের তীরন্দাজি, সাঁতার, ঘোড়দৌড়, কুস্তি ও পশুপ্রশিক্ষণের মতো খেলাধুলায় অংশ নিতে উৎসাহিত করেছেন। আবার এমন কিছু খেলাও ছিল, যেগুলো নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে সেগুলোর ক্ষতিকর দিক ও অনৈতিকতার কারণে। বর্তমান সময়ে যখন খেলাধুলা অনেক ক্ষেত্রে উন্মাদনায় রূপ নিচ্ছে এবং জীবনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও ধর্মীয় চেতনা থেকে মানুষকে বিচ্যুত করছে, তখন ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে খেলাধুলার সীমারেখা জানা খুবই প্রয়োজন। মানসিক ও শারীরিক বিকাশ সাধনের জন্য একাধিক খেলাধুলা ও প্রতিযোগিতায় উৎসাহিত করেছেন প্রিয়নবী মুহাম্মদ (সা.)। তেমনই কিছু খেলাধুলার বিবরণী তুলে ধরা হলো।
তীর নিক্ষেপ : হজরত রাসুলুল্লাহ (স.) তীর নিক্ষেপকে উৎসাহিত করে বলেন, ‘মহান আল্লাহ একটি তীরের অছিলায় তিনজন লোককে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। তীর নির্মাতা, যে নির্মাণকালে কল্যাণের আশা করেছে, তীর নিক্ষেপকারী এবং তা নিক্ষেপে সাহায্যকারী। তিনি আরও বলেন, তোমরা তীরন্দাজি করো ও ঘোড়দৌড় শিক্ষা করো। তবে তোমাদের ঘোড়দৌড় শেখার তুলনায় তীরন্দাজি শেখা আমার কাছে বেশি পছন্দনীয়।’ (জামে তিরমিজি)
সাঁতার : হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) সাঁতার শিখতে উৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, প্রত্যেক এমন জিনিস, যাতে মহান আল্লাহর স্মরণ নেই তা অর্থহীন, তবে চারটি বিষয় ছাড়া। তা হলো, দুই লক্ষ্যের মাঝে চলা, ঘোড়াকে প্রশিক্ষণ দেওয়া, স্ত্রীর সঙ্গে হাসি-কৌতুক করা, সাঁতার শেখা। (সুনানে কুবরা লিল-নাসায়ি)
ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা : হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) স্বয়ং ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করতেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ঘোড়ার দৌড় প্রতিযোগিতা করিয়েছেন। এই প্রতিযোগিতা হাফয়া থেকে শুরু হয়ে সানিয়্যাতুল বিদায় শেষ হতো। বর্ণনাকারী বলেন, আমি মুসা (রা.)-কে বললাম, এর দূরত্ব কী পরিমাণ হবে? তিনি বললেন, ছয় বা সাত মাইল। আর প্রশিক্ষণহীন ঘোড়ার প্রতিযোগিতা শুরু হতো সানিয়্যাতুল বিদা থেকে এবং শেষ হতো বনু জুরাইকের মসজিদের কাছে। আমি বললাম, এর মধ্যে দূরত্ব কতটুকু? তিনি বললেন, এক মাইল বা তার কাছাকাছি। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.)-ও এই প্রতিযোগীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। (সহিহ বুখারি)
মল্লযুদ্ধ : ইসলামের সোনালি যুগে একটি বহুল প্রচলিত খেলা ছিল মল্লযুদ্ধ। এমনকি দ্বীন প্রচারের স্বার্থে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) নিজেও একবার মল্লযুদ্ধে অংশ নেন। মক্কার একজন বিখ্যাত মল্লযোদ্ধা ছিল রুকানা ইবনে ইয়াজিদ। একদিন রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে দ্বীনের দাওয়াত দিলে সে তা প্রত্যাখ্যান করে। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে বলেন, আমি যদি মল্লযুদ্ধে তোমাকে পরাজিত করি, তবে কি তুমি মহান আল্লাহর ওপর ইমান আনবে? রুকানা তাতে সম্মত হয়। অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে মল্লযুদ্ধে পরাজিত করেন। (সিরাতে ইবনে হিশাম)
দৌড় প্রতিযোগিতা : হজরত সালামা ইবনে আকওয়া (রা.) বলেন, একজন আনসারী সাহাবি দৌড়ে খুবই পারদর্শী ছিলেন। দৌড় প্রতিযোগিতায় কেউ তাকে হারাতে পারত না। একদা তিনি ঘোষণা করলেন, আমার সঙ্গে দৌড় প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে কেউ প্রস্তুত আছে কি? আমি রাসুল (সা.)-এর নিকট এ ব্যাপারে অনুমতি চাইলে তিনি অনুমতি দিলেন। এ প্রতিযোগিতায় আমি জয়ী হলাম। (সহিহ মুসলিম)
দ্রুত হাঁটার প্রতিযোগিতা : দ্বীনের দাওয়াত, যুদ্ধের অভিযান ও জীবিকার অনুসন্ধানে বের হওয়ার পর তখনকার মানুষের ভেতর দ্রুত হাঁটার প্রতিযোগিতা হতো। দ্বীনি কাজে বের হয়ে এমন প্রতিযোগিতা করাকে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) উৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি দুই গন্তব্যের মধ্যে হাঁটে তার প্রতি পদক্ষেপে আছে প্রতিদান। (আত-তাবারানি ২/১৮০)
ভারোত্তোলন : তৎকালীন আরব সমাজে ভারোত্তোলন প্রতিযোগিতা ছিল। বলা হয়ে থাকে, সাহাবি হজরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.)-এর মাথায় এই খেলার ধারণা প্রথম আসে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) দৃষ্টিশক্তি হারানোর পর এমন একদল মানুষের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, যারা পাথর উত্তোলন করছিলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন তাদের কী হয়েছে? একজন বলল, তারা পাথর উত্তোলন করছে এবং দেখছে তাদের মধ্যে কে বেশি শক্তিশালী। তিনি বলেন, আল্লাহর পথের কর্মীরা তাদের চেয়ে শক্তিশালী। (ইরওয়াউল গালিল)
খেলাধুলা বৈধ হওয়ার কিছু মূলনীতি রয়েছে। তা উল্লেখ করা হলো। এক. আল্লাহর স্মরণ থেকে গাফেল না হওয়া এবং শরিয়তের মৌলিক বিধিবিধান পালনে বাধা না থাকা। দুই. আকিদা বা বিশ্বাসগত ত্রুটি-বিচ্যুতি না থাকা। তিন. জুয়া, বাজি ও শিরকের উপকরণ না থাকা। চার. অধিক সময় ব্যয় না করা। পাঁচ. প্রসিদ্ধি বা সুনাম কুড়ানোর চেষ্টা না থাকা। ছয়. খেলাকে পেশা বানানো যাবে না। সাত. জীবনের ঝুঁকি না থাকা। আট. পর্দার বিধান ও শালীনতা বজায় রাখা।
ইসলামি স্কলারদের মতে, এই মূলনীতিগুলো মেনে যেসব খেলাধুলায় চিত্তবিনোদন সম্ভব সেগুলো জায়েজ। তবে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) কিছু খেলাকে সরাসরি নিষিদ্ধ করেছেন। সেসব খেলাধুলা জায়েজ নেই। যেমন হাদিসে ‘নারদাশির’ তথা পাশা বা এর সমগোত্রীয় খেলার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। নারদাশির বলতে সেসব খেলাকে বোঝায় যাতে কাঠ বা প্লাস্টিকের তৈরি বাক্স কিংবা চৌকা রয়েছে। যেমন পাশা, লুডু, দাবা, শতরঞ্জ প্রভৃতি। ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, চার মাজহাবের ইমামদের দৃষ্টিতে ‘নারদাশির’ খেলা হারাম, চাই তাতে বাজি ধরা হোক বা না হোক। (মাজমুউল ফাতাওয়া ৩২/২৪৪)
কেননা, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি ‘নারদাশির’ খেলায় অংশগ্রহণ করল, সে নিজের হস্ত শূকরের রক্তে রঞ্জিত করল। (সহিহ মুসলিম) অপর হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি ‘নারদাশির’ খেলায় অংশগ্রহণ করল, সে আল্লাহ ও তার রাসুলের নাফরমানি করল। (আবু দাউদ)
উল্লিখিত খেলাধুলা ছাড়াও আরও অনেক নিত্যনতুন খেলা রয়েছে, যেগুলোর প্রকৃতি ও ধরন বিস্তারিত জেনে হুকুম প্রদান করতে হয়। সুতরাং সেগুলো সম্পর্কে ইসলামি স্কলারদের থেকে জেনে নিতে হবে।