মঙ্গলবার, ২৩শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

প্রশাসনকে দলমুক্ত করতে পারছে না সরকার

চাকরিতে নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে রাজনৈতিক পরিচয় জানতে চাওয়ার বিধান বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি। প্রশাসনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা নিয়ে বেশ চাপের মুখে আছে অন্তর্বর্তী সরকার। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি। তফসিল ঘোষণার পর প্রশাসনের কর্মকর্তারা দলীয় প্রশ্রয় খুঁজছেন আরও বেশি।

 

সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করবে। তাই রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালীদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে এখনই ব্যস্ত আমলারা। ফলে বর্তমানে প্রশাসনের রুটিন ওয়ার্ক চলছে ঢিমেতালে। পছন্দের দলের কাঙ্খিত নেতার মন খুশি করার চেষ্টা করছেন কর্মকর্তারা। অথচ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কোনো রকম যোগাযোগ রাখতে পারেন না। তফসিল ঘোষণার পর প্রশাসনের কাজে ধীরগতি এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দলীয় লেজুড়বৃত্তিতে হতাশ সাধারণ কর্মকর্তারা।

 

শেখ হাসিনার সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে তিনটি জাতীয় নির্বাচনে অন্যায় কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিলেন প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচন বড় দৃষ্টান্ত। এদের অনেকেই বাধ্যতামূলক অবসরে যান। আবার কাউকে ওএসডি করা হয়। কেউ কেউ কারাগারে আছেন। ধারণা করা হয়েছিল, এসব শাস্তি দেখে কর্মকর্তারা নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হবেন। কিন্তু সেটা হয়নি। কর্মকর্তাদের মানসিকতায় সংশোধনের লক্ষণ কম। আগামীতে ভালো থাকার আশায় রাজনীতিবিদদের মন জয়ের নেশা পেয়ে গেছে আমলাদের মধ্যে।

 

 

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ আইয়ুবুর রহমান খান আমাদের সময়কে বলেন, প্রশাসন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে দলীয় লেজুড়বৃত্তির কারণে। এর প্রভাব পড়ে যে কোনো নির্বাচনে। রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসারÑ সবই প্রশাসনের লোক। দলীয় নেতাদের সঙ্গে তাঁদের যোগসাজশ থাকলে কখনও সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করা যায় না। এত গেল নির্বাচনের দিক। এ ছাড়া প্রশাসনের কর্মকর্তারা কোনো দলের হয়ে কাজ করলে, এতে আমলাতন্ত্র থাকে না। এর মানে এই নয় যে, প্রশাসনের ব্যক্তিরা রাজনীতিবিদ্বেষী। বিষয়টি হচ্ছেÑ সরকারের কোনো কর্মচারী কোনো নেতার আশির্বাদপুষ্ট হলে তিনি অন্যায় সুবিধা নেবেন। এমন কী তাঁর মধ্যে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার মানসিকতা তৈরি হবে। তিনি নিজেকে জবাবদিহির ঊর্ধ্বে মনে করবেন, যা দেশের জন্য অকল্যাণকর।

 

সংশ্লিষ্টরা জানান, রাজনৈতিক মতাদর্শ যে কারও থাকতে পারে। কিন্তু প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী হয়ে নিজের দলীয় পরিচয় প্রকাশ করে ফায়দা লুটতে চাওয়া অনাকাক্সিক্ষত। এ কাজটি করার মূল কারণ পদোন্নতি ও পদায়ন বাগিয়ে নেওয়া। রাজনৈতিক সরকারের অধীনে দেশ চলবেÑ এটাই স্বাভাবিক। তাই রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় না রাখলে পদোন্নতি-পদায়নে অসুবিধা হতে পারে। এই চিন্তায় আগ থেকে বাড়তি যোগসাজশের চেষ্টায় লিপ্ত একটি অংশ। এভাবে প্রশাসনের চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ে বলে মনে করা হচ্ছে।

 

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৫ বছরে রাজনৈতিক বিবেচনায় পদোন্নতি ও পদায়নে সব রেকর্ড অতিক্রম করেছিল। ওই সময় যোগ্য, মেধাবী ও দলনিরপেক্ষ কর্মকর্তারা পদে পদে বঞ্চিত হয়েছেন। এ জন্য গোটা প্রশাসনে নেতিবাচক প্রভাব থাকায় ‘চেইন অব কমান্ড’ বলতে কিছু ছিল না। তৎকালীন মন্ত্রীরা তাঁদের মন্ত্রণালয় ও বিভাগে সচিব নিয়োগ পেতে আধা-সরকারি পত্র (ডিও লেটার) দেওয়া রীতিমতো রেওয়াজে পরিণত হয়েছিল। সিন্ডিকেটের সদস্যদের আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমেও সেই নিয়োগ ও পদায়ন হতো।

 

তথ্য মতে, প্রশাসনকে দলীয়করণ করার চেষ্টা বহুদিনের। জনতার মঞ্চ তৈরি করে আনুষ্ঠানিকভাবে আমলাতন্ত্রকে নষ্ট করা হয়েছে। ১৯৯৬ সালে জনতার মঞ্চ তৈরি করেন প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা। রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্তরা দেশের এ ক্ষতি করেছেন প্রশাসনকে দলীয়করণের মাধ্যমে। ক্ষমতাসীন দলগুলো আমলাতন্ত্রকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিলে ধরে নেওয়া হয় এবার বুঝি বন্ধ হবে লেজুড়বৃত্তি। কিন্তু তা সম্ভব হয়ে উঠেনি। ক্ষণিকের সময় উৎরিয়ে সম্ভাব্য ক্ষমতসীনদের দলগুলোর পছন্দের ব্যক্তি হতে শুরু হয় প্রতিযোগিতা। এর অংশ হিসেবে পদোন্নতি-পদায়ণ বাগিয়ে নেওয়া হয়। দেখাদেখি তরুণ কর্মকর্তারাও দলীয় নেটওয়ার্ক খুঁজছেন। অথচ গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর আশা করা হয়েছিল, দলীয় সিন্ডিকেট ভাঙবে। দেখা গেল অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিভিন্ন দলের পরিচয়ে অনৈতিক চাপ আসতে শুরু করে। বঞ্চিত কর্মকর্তা দাবি করে প্রশাসনের বিভিন্ন ব্যাচের কর্মকর্তারা সেøাগান, হাতাহাতিসহ ন্যক্কারজনক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। যোগ্য, মেধাবী ও দলনিরপেক্ষতার বদলে ঠাঁই দিতে হবে দলীয় সুযোগ সন্ধানীদেরÑ এমন দাবি প্রকাশ্য হয়ে গেছে। এ সুযোগে নৈতিক স্খলন, দুর্নীতিসহ নানা অনিয়মে শাস্তিপ্রাপ্ত কর্মকর্তারাও বাগিয়ে নেন পদোন্নতি ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পদায়ন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কক্ষে প্রকাশ্যে দলীয় পরিচয় দিচ্ছেন তাঁরা।

 

দীর্ঘদিন ধরেই সরকারি চাকরিতে নিয়োগ ও পদোন্নতিতে পুলিশ ও গোয়েন্দাদের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় প্রার্থী ও পদোন্নতি পাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীর নিজের ও তাঁর আত্মীয়স্বজনের রাজনৈতিক পরিচয় খোঁজা হয়। এর মাধ্যমে অনেক সময় চাকরির সুপারিশ পেয়েও অনেক প্রার্থীকে ‘বিরূপ মন্তব্যের’ কারণে নিয়োগ দেওয়া হয় না। একই কারণে অনেক যোগ্য কর্মকর্তা পদোন্নতি পান না। এ নিয়ে তীব্র আপত্তি থাকলেও সেটি বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে। এমন পরিস্থিতিতে পদোন্নতির ক্ষেত্রে পুলিশ বা কোনো গোয়েন্দা বিভাগের কাছে রাজনৈতিক পরিচয় জানতে চাওয়ার প্রথা বাতিল করার সুপারিশ করে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। কারণ হিসেবে কমিশন বলেছে, এ স্তর থেকেই জনপ্রশাসনে রাজনীতিকরণ শুরু হয়।

 

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ছিল, কোনো কর্মচারী যদি কোনো পদে পদোন্নতির সর্বোচ্চ ধাপে পৌঁছে যান এবং এরপর আর ইনক্রিমেন্ট না পান ও বিভাগীয় মামলায় গুরুদণ্ডে দণ্ডিত না হন, তাহলে তাঁকে দুই বছর পর পরবর্তী বেতন স্কেল দেওয়া। এ ছাড়া লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ফল ঘোষিত হওয়ার আগে কোনো প্রার্থীর পুলিশ ভেরিফিকেশন করা যাবে না। বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় চূড়ান্ত নিয়োগের আগে পুলিশ বিভাগের কাছে শুধু সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি মামলা আছে কি না, সে সম্পর্কে প্রতিবেদন চাইবে। প্রয়োজনে মন্ত্রণালয় দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রতিবেদন চাইতে পারে।

 

সংশ্লিষ্টদের মতে, নিরপেক্ষ কর্মকর্তা খুঁজতে গিয়ে বেকায়দায় আছে অন্তর্বর্তী সরকার। রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রশাসনকে ‘নিরপেক্ষ’ হতে বলা হচ্ছে। আবার কোনো কর্মকর্তা কোথায় দায়িত্ব পালন করলে প্রশাসন ‘দলীয় প্রভাবমুক্ত’ হবে, এ রকম নামও প্রস্তাব করা হয়। আবার কোনো কর্মকর্তাকে নির্দিষ্ট স্থানে বদলির প্রস্তাব করলে আরেক দলের অনুসারীদের পক্ষ থেকে আপত্তি আসে। সরকারের নানা স্তরে এরকম প্রস্তাব-আপত্তি আসার খবর শোনা যাচ্ছে। নিজের সুবিধা প্রশস্ত করতে ব্যাচমেট বা অধস্তনের ব্যাপারে মনগড়া অভিমতও দিচ্ছেন কেউ কেউ। বলা চলে নিরপেক্ষতার মোড়কে দলীয় মতাদর্শ বাস্তবায়নে ব্যস্ত প্রশাসনের কর্মকর্তাদের একটি অংশ।

 

এই পথ দেখিয়েছেন আওয়ামীপন্থি কর্মকর্তারা। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনা উপ প্রেস সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আবু আলম শহীদ খান। পরে ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় ফিরলে শহীদ খানকে ওএসডি হয়ে থাকতে হয়। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এলে তিন মাসের মধ্যে পরপর চারটি পদোন্নতি দিয়ে তাঁকে জ্যেষ্ঠ সচিব করা হয়। ওই সময় তিনি অত্যন্ত প্রভাবশালী সচিব হিসেবে পরিচিত ছিলেন। স্থানীয় সরকার বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব হিসেবে তিনি ২০১৫ সালে অবসরে যান। ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচন করতেও আগ্রহী ছিলেন সাবেক এই আমলা।

 

এর আগে ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকারের শেষ সময়ে সচিবালয়ে আওয়ামীপন্থি কিছু আমলাকে নিয়ে গঠিত হয় ‘জনতার মঞ্চ’। ওই মঞ্চ গঠনের প্রধান কুশীলব ছিলেন তৎকালীন পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) ড. মহীউদ্দীন খান (ম খা) আলমগীর। পরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তাঁর হাত ধরে প্রশাসনে দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির মহোৎসবের সূচনা হয়। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব এইচটি ইমাম (প্রয়াত) প্রশাসনে দুর্নীতি ও রাজনীতিকে ‘প্রাতিষ্ঠানিক’ রূপ দিয়ে যান। ওই সময়ে ১৯৯৬ সালে সচিবালয়ে তৎকালীন বিএনপি সরকারবিরোধী জনতার মঞ্চের অন্যতম সংগঠক ছিলেন আবু আলম মোহাম্মদ শহীদ খান। ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে রংপুরে নির্বাচনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন তিনি।

শেয়ার করুনঃ