শুক্রবার, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

আহ্ স্মৃতির ঝাঁপি আজ গেলো খুলে ; এ ব্যথা যাবে কী গলায় দড়িঁ দিয়া মরিলে!

লেখকঃ অধ্যাপক আব্দুস সহিদ খান

ড্রাইভার মিলন এসে বলল: ভাবি একটা বুড়ো এসেছে। বলছে ভাইয়ার সাথে দরকার আছে।

কে? নাম কি? কোথা থেকে এসেছে?

বলছে তো ভাইয়ার গ্রামের লোক। খুব দরকার।

দরকার তো আমি জানি। যত হাভাতে লোকগুলো আসে এ’ভাবে যখন তখন। তোদের ভাইয়াকে ইনিয়ে বিনিয়ে দুঃখের কথা বলবে। সেও গলে যাবে আর কিছু টাকা খসবে আমাদের।ডিসগাস্টিং!বিদায় কর এক্ষুণি।

আর শোন তোর ভাইয়ার কানে যেন এ’সব কথা না যায়।

আজ আমার একমাত্র ছেলে মাহির জন্মদিন। সব নিমন্ত্রিতরা এসে যাবে একটু পরেই।এর মধ্যে একফাঁকে পার্লারে গিয়ে একটু তৈরী হয়ে আসব ভাবছি, তার মধ্যে এই উটকো আপদ এসে জুটল।

একটু পরেই মিলন ফিরে এল আবার; পিছন পিছন এক হাড় – হাভাতে চেহারার গেঁয়ো বুড়ো।

আচ্ছা ঝামেলায় পড়েছি ভাবি.. মিলন মুখ খুলতে না খুলতেই শুনি: বৌমা… বুড়োটা বলছে…আমাকে তুমি চিনবে না মা, আমি জহিরের…

কথাটা শেষ করতে দিলাম না। হাত তুলে বললাম:দেখুন, আপনি কে তা আমি জানতে চাইনা, আমার বাড়ীতে আজ একটা অনুষ্ঠান আছে, আমার সময় নেই আপনার বাজে কথা শোনার। টাকা চাইতে এসেছেন তো! ঐরকম অনেকেই আসে আমার স্বামীর গ্রামতুত সম্পর্ক ধরে; আপনি এখন আসুন। আমার স্বামী বাড়ীতে নেই।

অনেকদূর থেকে এসেছি মা। আমার বিশেষ দরকার। তাছাড়া বুড়ো হয়েছি, পথঘাট ঠাহর করতে পারব না রাতে। জহিরের সাথে কাজের কথা সেরে , কাল সকাল সকাল চলে যাব।

নাছোড়বান্দা বুড়ো তো! মিলনকে বললাম: একটা কাজ করো।সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে আজকের রাতটা থাকতে দাও একে।কাল দেখা যাবে।

দারুণ হৈ- হুল্লোড় হ’ল পার্টিতে। আমার আর মাইনুর সব কলিগ, ওর বস, অহনের বন্ধুরা …সবাই এসেছিলেন।অনেক দামী দামী গিফট পেল মাহি।

সকালে ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরীই হয়ে গেল।অবশ্য অসুবিধে নেই তাতে।আজ সেকেন্ড ফ্রাইডে।আমাদের তিনজনেরই ছুটি।

মিনু চা নিয়ে এল, আর,আমার হাতে ধরিয়ে দিল একটা খাম।

কি এটা?

ঐ বুড়ো ভদ্রলোক দিয়ে গেছেন ভাবি।বলেছেন, এটা আপনাকে দিয়ে দিতে।

বাব্বা! ভদ্রলোক! মিনুর আদিখ্যেতা দ্যাখো একবার!!

কি আছে এতে? দেখি তো খুলে।

স্নেহের বৌমা

তুমি আমার মরহুম ভাই -ভাবি সায়রা বানু আর সাইদুল করিমের একমাত্র ছেলে জহিরের বৌ।ভাই- ভাবি যখন গ্রামে এক অজানা রোগে মারা গেলেন, জহির তখন ছ’মাস বয়স।আমার স্ত্রী সবজান ওকে বুকে তুলে নিল।আমি নিঃসন্তান।জহিরকেই নিজের ছেলের মত বড় করলাম আমরা।

গ্রামের পড়া শেষ করার পর, ঢাকায় হস্টেলে রেখে ওকে পড়ালাম।তখন থেকেই ও বিশেষ যেত না গ্রামে।আমি আসতাম।দরকার মত টাকা- পয়সা দিয়ে যেতাম।

ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হ’ল জহির। আমি আর তেমন আসা যাওয়া করতে পারতাম না। মানি অর্ডার করতাম দরকার মত।

বাইরে পড়তে গেল ও। তারপর ফিরে এসে জয়েন করল বিশাল চাকুরিতে।আমার দশটা চিঠির উত্তরে একটা উত্তর দিত । বুঝতাম , কাজের চাপ। তাও আশায় ছিলাম, একবারের জন্যও যদি বুড়ো চাচা – চাচীমাকে এসে দেখে যায়!

একদিন একটা পোস্টকার্ড পাঠাল জহির, তোমাদের বিয়ের খবর জানিয়ে।মনকে সান্ত্বনা দিলাম, অন্তত খবরটুকু তো দিয়েছে।তারপর আর কোন খবর পাইনি।

সবজান শয্যাশায়ী। ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছেন।আজকাল বাচ্চাদের মত বায়না করে, জহিরকে দেখবে বলে।কি করে পাই জহিরের ঠিকানা! কপাল ঠুকে ঐ অফিসের ঠিকানায় চলে এলাম।ওখানে গিয়ে শুনি আজ জহির অফিসেই আসেনি।বাড়ীতে নাকি অনুষ্ঠান।

রিসেপশনিস্ট মেয়েটিকে অনেক অনুরোধ করায়, আমাকে এই ঠিকানাটা দিল।

কিন্তু শুধুমাত্র সবজানের কথা ভেবেই আসিনি আমি।

আমার আর ভাইয়ের দশ বিঘা জমি ছিল গ্রামে। যা ফসল আর ফল পাকুড় হত, তা বিক্রীর পয়সা ব্যাঙ্কে জমা করতাম আমি।এখন বয়স হয়েছে। আর চাষবাসের দেখাশুনো করতে পারিনা ঠিকমত। তাই বসত- বাড়ীটুকু রেখে, বাকী জমি বিক্রী করে দিলাম।

ফসল বিক্রীর আর জমি বিক্রী বাবদ ত্রিশ লাখ টাকার চেক আমি দিয়ে গেলাম।দায়মুক্ত হ’লাম আমি আজ।

তোমরা ভাল থেকো।নাতিসাহেবকে আমার অনেক অনেক আদর আর দোয়া জানিও।

ফিরে গিয়ে সবজানকে বলব যে, তোমরা বিদেশে আছ!আমি তোমাদের খুঁজে পাইনি!কাঁদবে জানি খু..উ..ব।

আমি চললাম।আর কোনদিন আসব না বিরক্ত করতে।

শাহ্ আব্দুল্লাহ।

… … বড় অহংকার ছিল আমার। সুন্দরী, উচ্চশিক্ষিতা, বর সুচাকুরে। পার্টিতে গেলে আমার সান্নিধ্য পেতে কত পুরুষ লালায়িত থাকে।..আজ ঐ বৃদ্ধ মানুষটি এক লহমায় আমার সব অহংকারকে গুঁড়িয়ে দিয়ে গেলেন…..

আহ্ স্মৃতির ঝাঁপি আজ গেলো খুলে; এ ব্যাথা যাবে কী গলায় দঁড়ি দিয়া মরিলে!!

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২১৩১৪১৫
১৬১৭১৮১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭২৮২৯
৩০৩১  

All Rights Reserved ©2024