শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

স্বপ্নের ঠিকানা নেই

লেখকঃ আফতাব মল্লিক

পাঁশকুড়া স্টেশনে ভাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে হঠাৎই পা পিছলে পড়ে যায় শিউলি। সদ্য নামা কয়েকজন তাকে ধরে প্লাটফর্মের একটা বেঞ্চে বসিয়ে দেয়। কয়েকজন লোক দেখানো সহানুভূতি মানে ” আহা! খুব লেগেছে বুঝি ? শুকনো আপদ একেই বলে ! ইত্যাদি এ ধরনের কথা বলে চলে যায়। তারা মধ্যে একজন বয়স্কা মহিলা বলেন মা, তুমি ঐ ট্যাপে গিয়ে একটু ঠান্ডা জল নাও । আরাম লাগবে। তারপর আস্তে আস্তে হেঁটে যেও। সব ঠিক হয়ে যাবে। উনার কথা শুনে শিউলি অনেক কষ্ট করে ট্যাপের কাছে গিয়ে জল নেয় । আরাম হয়তো একটু লাগছে কিন্তু গোড়ালিটা ক্রমশ ফুলে যাচ্ছে। অনেক চেষ্টা করেও সে আর উঠে দাঁড়িয়ে বেঞ্চে গিয়ে বসতে পারছে না। হঠাৎ পেছন থেকে একটা পুরুষ কণ্ঠস্বর। আরে কি হলো আপনার ? পড়ে গিয়েছেন ? কিভাবে ? এ বাবা! আপনার পা তো ফুলে গেছে অনেকটা ! দাঁড়ান দাঁড়ান। আমাকে ধরুন । উঠে দাঁড়ান । চলুন ঐ বেঞ্চে বসাই আপনাকে। খুব কি যন্ত্রনা হচ্ছে আপনার ? হাড়ে চিড় ধরলে কিন্তু খুব যন্ত্রনা হয়। “হ্যাঁ”। খুব যন্ত্রনা হচ্ছে। কান্না ভেজা গলায় বলে শিউলি। ওহ্ তাহলে তো এক্স রে করতে হবে এখুনি,। আপনি আমাকে ধরে হাঁটতে পারবেন তো ? না না ঠিক আছে । ঠিক হয়ে যাবে এমনি। বলে শিউলি। তা কি করে হয় ? আপনি দাঁড়াতে পারছেন না আর আমি আপনাকে ছেড়ে চলে যাবো ? ধরুন আমাকে। একটু কষ্ট করে হেঁটে যেতে হবে আপনাকে।স্টেশন থেকে একটু হাঁটলে ঐ মাছ মার্কেটের পরেই নার্সিং হোম। ওখানে নিয়ে যাই আপনাকে চলুন। নার্সিং হোমে এক্স রে রিপোর্টৈ দেখা যায় গোড়ালির ওপরে হাড়ে সামান্য চিড় ধরেছে। নার্সিং হোমের ম্যানেজার বললেন ডাক্তার বাবু একটু আগে বেরিয়ে গেছেন। ঘন্টাখানেক বাদে ফিরবেন। উনি এলেই প্লাস্টার হবে। আপাতত এই ঔষধ দুটো খাইয়ে দিন । ম্যানেজারের কথা শুনে ছেলেটা বলল আচ্ছা ঠিক আছে। তারপর শিউলির কাছে এসে বলল, মিনিট কুড়ি আপনি একা বসতে পারবেন এখানে ? আমি একটু অফিসে যাবো আর আসবো। আমি ব্যাঙ্কে কাজ করি। এখান থেকে মিনিট পাঁচেক সোজা হেঁটে পাঞ্জাব ব্যাঙ্কের যে ব্রাঞ্চ আমি ঐ ব্রাঞ্চে আছি। আজ তো আর অফিস করা হবে না। আমি জাস্ট স্টাফদের বুঝিয়ে দিয়েই আসবো। ততক্ষণে নিশ্চয় ডাক্তার বাবুও এসে পড়বেন। না না আপনি অফিস অ্যাটেন্ড করুন। আমি কোনোভাবে স্টেশনে চলে যাবো তারপর বাড়িতে ফোন করে ভাইকে ডেকে নেবো। ব্যাথা ভরা গলায় বলল শিউলি। সে আপনি একশ বার পারেন। কিন্তু এভাবে আপনাকে ফেলে রেখে আমিই বা যাই কি করে। আপনি চুপচাপ এখানে বসুন আমি পনেরো কুড়ি মিনিটের মধ্যে আসবো । আপনি আমার ফোন নম্বরটা রাখুন। ৭০০১৪০,,,,,,,,,,। আমার নাম শৌভিক। অসুবিধা না থাকলে সেভ করে রাখতে পারেন। না হলে আমাকে একটা কল করে নেন, আমি দেখে নিচ্ছি আপনার নম্বরটা। তাহলে আমি আসি? আলতো করে ঘাড় নাড়ে শিউলি। শৌভিক চলে যাওয়ার পর ভাইকে ফোন করে সব ঘটনা বলে শিউলি। আর বলে যে এক্ষুনি বাড়িতে বলিসনা। তাহলে বাবা মা চিন্তা করবে। ওরাও আসতে চাইবে এখানে। আমি গিয়ে বলবো বরং। আধ ঘন্টা পর ফিরে আসে শৌভিক। তারও ঘন্টা খানেক বাদে ডাক্তার বাবু এলে ওর প্লাস্টার হয়। টাকা পয়সার কথা বললে শৌভিক বলে, ও নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। এখন আমি পে করে দিচ্ছি। পরে সময় করে না হয় আমাকে দিয়ে দেবেন। আর আমি অতো ধনী না যে আপনাকে দান করবো। কথাটা শুনে হেসে ফেলে শিউলি। ওরা দুজন বেডে বসে গল্প করছে। এখনো ওর ভাই আসেনি। আসলে মেদিনীপুর থেকে পাঁশকুড়া পর্যন্ত এ লাইনে এক দেড় ঘন্টা ছাড়া ছাড়া লোকাল। শিউলির বাড়ি মাদপুর । ঘন্টা দুয়েক পরে ভাই এলে ক্যাশ কাউন্টারের কাজ মিটিয়ে বাড়ির জন্য বের হয় শিউলি। শৌভিক বলে আমার বাড়ি হাউর স্টেশন থেকে পাঁচ কিলোমিটার উত্তরে। আমি প্রতিদিন ঐ নটা বাইশের ডাউন মেদিনীপুর লোকালটাতে আসি। বাড়ি পৌঁছে একটা ফোন করে দেবেন। নিশ্চয়ই,বলে শিউলি। ঐ দিনের পর থেকে প্রায়ই টুকটাক কথা হতো শৌভিকের সাথে। কলেজ জীবনে দুচারজন প্রপোজ করলেও কাউকে পাত্তা দেয়নি শিউলি। শৌভিকের প্রতি এখন সে অসম্ভব দুর্বল হয়ে পড়েছে। মনে মনে ভালোবেসে ফেলেছে অনেক। কিন্তু বলবে কিভাবে বুঝতে পারছে না। একদিন রাতে ঘুমানোর আগে শৌভিককে হোয়াটসঅ্যাপ লেখে শিউলি। ” আপনার সাথে আমার পরিচয় খুব বেশিদিনের না। তাও আবার একটা দুর্ঘটনার মাধ্যমে। সেদিনের আপনার ঐ ব্যবহারের পর থেকে আপনার প্রতি আমার একটা দুর্বলতা জন্মাতে থাকে। এখন সেটা ভালোবাসায় পরিনত হয়েছে। আপনাকে ফোনে বলার সাহস হয়নি তাই হোয়াটসঅ্যাপ করলাম। আপনি যদি আমাকে পছন্দ করেন তাহলে আমাকে একটা লাভ রিয়্যাক্ট পাঠাবেন। না পাঠালে আমি বুঝে নেবো আপনি সম্পর্কেটা চাইছেন না। আর আমিও আপনাকে ফোন করবো না। কারন আমি আপনাকে হারিয়ে আপনার সাথে সম্পর্ক রাখতে পারবো না। ভালো থাকবেন “। না। শৌভিক লাভ রিয়্যাক্ট পাঠায়নি। শিউলিও আর কোনদিন ফোন করেনি। আসলে দোষটা দুজনেরই। শিউলি কোনোদিন জানতে চায়নি শৌভিক বিবাহিত কি না। আর শৌভিকও এতদিন কথা বলার সময় একবারও বলেনি সে বিবাহিত। হয়তো বলার মতো পরিস্থিতি আসেনি। তার একটা এক বছরের মেয়েও আছে। হোয়াটসঅ্যাপ পড়ে শৌভিক চাইলেই রিপ্লাই করতে পারতো সে বিবাহিত। কিন্তু শিউলিকে ডাইরেক্টলি কষ্টটা দিতে চায়নি। চাইছিল শিউলি নিজের থেকে কিছু একটা অনুমান করে নিক। এসব ঘটনা চার বছর আগেকার। ঐ ঘটনার পাঁচ মাস পরে শিউলির থার্ড ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষা হয়। বাড়ি থেকে চাইলেও ও আর পড়াশোনা কন্টিনিউ করতে চায়নি। হয়তো আবার পাঁশকুড়া যেতে হবে ,এম এ তে এ্যাডমিশন নিলে তাই। তার পরের বছর বিয়ে হয়ে যায় শিউলির। আজ চার বছর পর স্বামীর সাথে পাঁশকুড়া এসেছে সে “আকাশ টেলার্স” এ। কয়েকটা জামা তৈরী করার ইচ্ছে হলো হঠাৎ। কলেজ লাইফে এখান থেকেই জামা তৈরী করাত ও। প্লাটফর্মে বসে আছে ওরা। ট্রেনের টাইম হতে এখনও কুড়ি মিনিট বাকি। হঠাৎ শিউলি তার স্বামীকে বলে, তুমি একটু বসো, আমি ওয়াস রুম থেকে আসছি। দুরে প্লাটফর্মে হেঁটে আসা শৌভিকের সামনাসামনি হতে চায়নি হয়তো। সময় কতো সহজে বয়ে চলে তাড়াতাড়ি। অথচ সময়কে মনে রাখা মানুষগুলোর জীবন কাটাতে চায় না কিছুতেই!

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০  

All Rights Reserved ©2024