মিশিগানের মেয়ে রেবেকা

দেখতে দেখতে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে প্রথম প্রজন্ম হিসেবে আমাদের অনেকটা সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। এদেশের অভিবাসন ভিসা পদ্ধতি কিংবা স্টুডেন্ট ভিসা বা অন্যান্য উপায়ে প্রবাসী হয়ে আমরা যারা একদিন গ্রিন কার্ডধারী হয়ে বসবাস শুরু করি, তাদের অনেকের পরিবারেই জন্মগ্রহণ করেছে অসংখ্য নতুন প্রজন্ম।

সেই সাথে অনেক ছেলেমেয়ে যারা অল্প বয়সে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিল তারাও আজ বড় হয়ে গেছে।দিনে দিনে সময় যতই এগুচ্ছে, ততই এই নতুন প্রজন্মের সংখ্যা দ্রুত গতিতে বেড়ে চলেছে এবং এরা পাশ্চাত্যের সঠিক শিক্ষা-দীক্ষা আর সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের স্বাচ্ছন্দ্যময় পরিবেশের মধ্যে থেকে বেড়েও উঠছে আপন গতিতে।

সেদিন হয়তো বেশি দূরে নয়, যেদিন আমাদের এই সন্তানেরা ধীরে ধীরে এদেশের মূলধারায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে নিজেদেরকে আদর্শ নাগরিক হিসেবে, খাঁটি আমেরিকান হিসেবে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অফিসে, ব্যবসা-বাণিজ্যে, রাজনীতিতে এমনকি রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে আসীন হতে সক্ষম হবে। আমরা দেখতেও পাচ্ছি, সেই সুন্দর স্বপ্ন ইতোমধ্যে কোথাও কোথাও বাস্তবায়ন হতেও শুরু করেছে। কারো কারো সন্তান আজ আমেরিকান মূলধারার কর্পোরেট অফিসে, ব্যবসা বানিজ্যে ও আইটি সেক্টরে শীর্ষ আসনগুলো দখল করে নিয়েছে মেধা দিয়ে।

বাংলাদেশে জন্ম রেবেকা ইসলামের। পাঁচ বছর বয়সে বাবা-মায়ের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান স্টেটে চলে আসেন তিনি।রেবেকা ইসলাম মিশিগানের হ্যামট্রামেক শহরে বড় হয়েছেন। সেখানেই তার বেড়ে ওঠা ও পড়াশোনা। ডেট্রয়েট পাবলিক স্কুলে তার প্রাথমিক শিক্ষা।

হাই স্কুলে অধ্যয়নরত অবস্তায় রেবেকা তার নিজের সম্প্রদায়ের জন্য কাজ করা শুরু করেন. স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে তিনি APIA VOTE- MI এবং রেড ক্রস আমেরিকার নানা ধরনের সমাজ কল্যাণ প্রকল্পে কাজ করেন। তার স্বভাব এবং নেতৃত্বে মুগ্ধ হয়ে ২০১০ সালে আমেরিকান রেড ক্রস তাকে ইয়ুথ লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড দিয়ে সম্মাননা জানায়।

 

হাই স্কুল শেষ করার পর, রেবেকা ওয়েন স্টেট ইউনিভার্সিটিতে বায়োলজি এবং সাইকোলজি নিয়ে স্নাতক অধ্যয়ন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধায়নরত রেবেকা APIA VOTE- MI এর কমিউনিটি অর্গানাইজার পদে কাজ করা শুরু করেন। APIA VOTE- MI কর্মরত থাকা অবস্তায় রেবেকা লক্ষ্য করেন যে, অভিবাসী অধ্যুষিত সম্প্রদায়ে আমেরিকার মূলধারার রাজনীতি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা ও সচেতনতার প্রচণ্ড অভাব। এই সচেতনতার অভাবের কারণে, অভিবাসীরা প্রতিনিয়ত ন্যায্য নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকেন, এবং ক্রমে ক্রমে অন্যান্য সম্প্রদায় থেকে অনেক পেছনে পরে থাকেন।

এই অবস্তার উন্নতি করার জন্য রেবেকা তখন তার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে কমিউনিটি সার্ভিসের মাধ্যমে অভিবাসী এবং সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর জন্য কাজ করতে দৃঢ় ইচ্ছা পোষণ করতে লাগলেন। এর পর থেকে গত এক দশক ধরে রেবেকা  APIA VOTE- MI এর বিভিন্ন পদে কাজ করার মাধ্যমে, অভিবাসী অধিকার, নাগরিক অধিকার, অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, আবাসন, জনস্বাস্থ্য এবং ভোটাধিকার সম্পর্কিত সমস্যাগুলির সমাধানের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।

কঠোর পরিশ্রম এবং দৃঢ়তা নিয়ে কাজ করতে করতে রেবেকা বর্তমানে APIA VOTE- MI এর এক্সেকিউটিভ ডিরেক্টর পদে উপনীত হয়েছেন। এর পাশপাশি তিনি, মিশিগান স্টেট লিগ অফ উইমেনস ভোটার, আমেরিকান সিটিজেনস ফর জাস্টিস, এবং ওয়াশিংটন ডিসি – ভোটার ক্ষমতায়ন প্রকল্প গুলোতে বোর্ড ডিরেক্টর হিসাবে কাজ করছেন।

রেবেকা এবং তার সংস্থা ২০২০ সালের নির্বাচনে AAPI ভোটার বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২০২০ সালের নির্বাচনের জন্য, APIA VOTE- MI, বিপুল সংখ্যক নতুন এশীয় আমেরিকান নাগরিকদের ভোট দেয়ার জন্য নিবন্ধিত করেন। শুধু তাই নয়, সেক্রেটারি অফ স্টেট অফিসের সাথে কাজ করে তার সংস্থা বাংলা সহ অনেক এশীয় ভাষায় ভোটের উপকরণ অনুবাদ করতে সহায়তা করার মধ্যমে নিশ্চিত করেছেন যে অভিবাসী সম্প্রদায়ের একাধিক অনূদিত ভাষায় ভোটদানের সংস্থান রয়েছে।

কোভিড-১৯ মহামারী যখন বিশ্বে আঘাত হানে, তখন রেবেকা এবং তার সংস্থা AAPI সম্প্রদায়গুলিকে সাহায্য করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করা শুরু করেন। প্রথমে তারা কমিউনিটির মানুষের মাঝে বিনামূল্যে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম বিতরণ করেন। তারপর, APIA VOTE-MI মানুষের কাছে কোভিড টেস্টিং এবং কোভিড ভ্যাকসিন নিয়ে আসে। তদুপরি, তারা এই কঠিন সময়ে দৈনন্দিনের প্রয়োজনীয় খাবার বিতরণ করে সম্প্রদায়ের মানুষের সেবা করে চলেছেন। তার কঠোর পরিশ্রম এবং উত্সর্গের কারণে, মিশিগান গভর্নরের অফিস সম্প্রতি তাকে মিশিগান হিরো পুরস্কারে ভূষিত করেছে।

মহামারীর সময়ে, এশিয়ান আমেরিকানদের বিরুদ্ধে, ঘৃণামূলক অপরাধ অকথ্যভাবে বেড়ে যায়। জর্জিয়ার আটলান্টায় এশিয়ান বংশোদ্ভূত ৬ জন মহিলাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল।রেবেকা এশিয়ান সম্প্রদায়ের উপর এই অমানবিক নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাধের জন্য একাধিক সমাবেশের আয়োজন করেছিলেন। AAPI সম্প্রদায়ের সাথে একাত্বতা ও সমর্থন জানাতে এইসব প্রতিবাদ সমাবেশে সর্বস্তরের শত শত মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল।

রেবেকা মিশিগান রিডিস্ট্রিক্টিং কমিশনের আউটরিচ এবং কমিউনিকেশন কমিটির একজন সক্রিয় সদস্য। রেবেকা রাত দিন কাজ করে নানা সম্প্রদায়ের মানুষকে একসাথে সংযুক্ত করেন এবং তাদের মাধ্যমে রিডিস্ট্রিক্টিং কমিশনকে বাংলাটাউনকে এক ডিস্ট্রিক্টে রাখার জন্য সুপারিশ করেন। রেবেকার নেতৃত্ব এবং তার সংগঠনের কঠোর পরিশ্রমের ফলে, ২০২১ সালের মিশিগান রিডিস্ট্রিক্টিং কমিশন মিশিগানের বাংলাটাউনকে এক ডিস্ট্রিক্টে রাখার প্রতিশ্রুতি দেন। মিশিগান ইন্ডিপেন্ডেন্ট সিটিজেনস রিডিস্ট্রিক্টিং কমিশনের কমিউনিকেশন এবং আউটরিচ ডিরেক্টর, এডওয়ার্ড উডস, রেবেকাকে তার অক্লান্ত পরিশ্রমের জন্য স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং তাকে তৃণমূল নেতাদের জন্য একটি আদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।

রেবেকা অবসর সময়ে বিভিন্ন স্থানীয় প্রচারাভিযান এবং আন্তঃধর্মীয় সংগঠনের সাথে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতে বেশি আনন্দ বোধ করেন। তিনি ভ্রমণ করতে ভালবাসেন, এবং পরিবারের সাথে সময় কাটাতে পছন্দ করেন। এবং সেই সাথে তিনি জানালেন, “ আমার প্রতিটি কাজে আম্মু যেমন উৎসাহিত করেন তেমনি আব্বু ও আমাকে বলেন, “আমরা কোথায় যাব জানি না, আমাদের জীবনে কী ঘটবে আমরা জানি না। কিন্তু আমাদের মাথার ভেতরে কী আছে সেটা যেমন অন্যরা জানে না, তেমনি সেটা কেউ ছিনিয়ে নিতেও পারবে না।”

হ্যাঁ আসলে আব্বু ঠিক বলেন। মিশিগানের ওয়েন ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক পাস করেছি। আমি সবাইকে বলবো মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি তার মাথা খাটানোর ক্ষমতা। আমরা প্রত্যেকেই নিজের কর্মের মাধ্যমে স্বপ্ন পূরণ ও সফলতা লাভ করতে চাই। নিজের জীবনকে সাজাতে চাই আমাদের মনের মত করে। তবে সাফল্য অর্জন যে একদিনে আয়ত্ত করা সম্ভব নয়, সেটা আমি বিশ্বাস করি।পৃথিবীর সব সফল ব্যাক্তিবর্গের স্বার্থকতার পেছনে রয়েছে তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং দীর্ঘ অপেক্ষা। লক্ষ্য স্থির করে ধাপে ধাপে পৌছাতে হয় সাফল্যের উচ্চতর শিখরে, হতে হয় ধৈর্যশীল। আর আমিও তা আপ্রান চেষ্টা করছি।”