শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

কবি বজলুর রশীদ চৌধূরী ও ‘গ্রামবাংলার কবি ও কবিতা’

মুহাম্মদ বদরুল ইসলাম শাকিরঃ কবি জীবনানন্দ বলেছিলেন, সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি। সময়ের পরিক্রমায় এ কথা কতোটা  প্রাসঙ্গিক তা আমরা নিশ্চয়ই সমসাময়িক সাহিত্য চর্চার দিকে তাকালে বুঝতে পারি। কেবল কয়েকটি লাইন ধারাবাহিক লিখলেই তা কবিতা হয় না, যিনি লিখেন তিনিও কবি হয়ে যান না। কবিতার জন্য প্রয়োজন একটি কবি মন। একজন কবি যে অবস্থায়ই থাকুন না কেন, তিনি থাকেন তাঁর জায়গায় সৎ, তাঁর মনের আলাদা একটা জায়গা যত্ন করে রাখা থাকে একটি সংরক্ষিত লকার। যেখানে তাঁর কল্পনা জমা থাকে কবিতার জন্য।
কবি বজলুর রশীদ চৌধূরী এমনি এক কবি সাত সমুদ্র-তেরো নদীর ওপারে বিদেশের মাটিতে থাকলেও তার মন থাকে কবিতায় জড়িয়ে , তাঁর দেশের তরে ফলে শত ব্যস্ততা আর বাস্তবতা কাটিয়ে তিনি কবিতা লিখেছেন, গান লিখেছেন। কবি বজলুর রশীদ চৌধূরীর ‘গ্রামবাংলার কবি ও কবিতা’ বইটির  পাতায় পাতায় চোখ দিলে মন ভরে উঠে। প্রতিটি কবিতা অপূর্ব। প্রতিটি শব্দের গাঁথুনি অনিন্দ্য সুন্দর। কবির লেখায় জড়িয়ে আছে দেশের কথা, তাঁর মায়ের কথা, তাঁর গাঁয়ের কথা। এসব থেকেই বুঝা যায় দেশের প্রতি কবির কত টান!
কবি বজলুর রশীদ চৌধূরীর কবিতা দিকে তাকালে মনে পড়ে যায় পল্লী কবি জসিমউদদীনের কথা পল্লীকবি শহরের মানুষ হলেও যেমন তাঁর কবিতায় গ্রামের সহজ-সরল মানুষের কথা সরলভাবে ফুটে উঠতো কবি বজলুর রশীদ চৌধূরীর গাঁয়ের চাষী, গাঁয়ের বধূ, নায়ের মাঝি, স্বপ্নের সাধু শিরোনামের লেখাগুলোতে যেন সেই রূপই খুঁজে পাওয়া যায়। কবিতায় তাঁর সহজসরল উচ্চারণ কখনো ভিজিয়ে দেয় চোখ জসিমউদদীনের কবর কবিতার মত। যেমন তিনি লিখেছেন –
মায়ের কথা মনে হলে চোখে আসে জল/ মা-ই আমার পরম শান্তি, মা-ই গায়ের বল।/মা আমার মাথার মণি মাকে ভালোবাসি /সকল দুঃখ দূরে যায় দেখলে মায়ের হাসি। /মায়ের কোলে মহা শন্তি, সাধু শাস্ত্র কয় / মা বিহনে ত্রিভুবনে আপন কেহ নয়।
কবি বজলুর রশীদ চৌধূরী একজন সমাজ সচেতন কবিও। কেবল কল্পনার রাজ্যে আরব্যরজনীর কল্পকাহিনির মত তিনি কলম চালান না। তাই তাঁর কবিতায় ওঠে এসেছে সমকালীন প্রসঙ্গ। তিনি আরাকানে মুসলিম নির্যাতন নিয়ে লিখেছেন, যেখানে তিনি মুসলমানদের অতীত মনে করিয়ে দিয়ে ধৈর্যের বাণী শুনিয়েছেন। শুনিয়েছেন বিশ্ববাসীকে ইসলামের মহানুভবতা। তিনি আরাকানে মুসলিম নির্যাতন নিয়ে মুসলমানদের আর্তনাদ শিরোনামে লিখেছেন – মুসলিম তুমি শান্ত জাতি ধৈর্য ধরে থাকো /জমাট বাঁধা নালিশ যত মাওলার কাছে রাখো। /তোমার দুঃখের চিত্রকথা হাওয়ায় চলছে ভেসে/নির্বোধ যারা নিধন করে যারা শান্তির কথা বলে/সামনে তাদের কঠিন বিপদ ফাঁসির রশি গলে। /মাওলার উপর বিশ্বাস রাখো হারিয়ো না ঈমান/খুনি পাপী হবে ধ্বংস সবই হবে ময়দান। মারছে যারা মরবে তারা কেউ রবে না ধরায় /গায়ের বল হবে তল কাঁদবে হায়রে হায়/শোনো মুমিন এই জমিন পড়ে রইবে সারা/মেনে তাওহীদ হও মুরিদ নবীর প্রেমে পিয়ারা/।
নীরব ঘাতক করোনাভাইরাসের ভয়াবহতাও ওঠে এসেছে কবির কবিতায়। সেই বিদেশের মাটিতে থেকেও দেশের মানুষের জন্য কেঁদেছে তাঁর মন। তিনি বিশের বিষ শিরোনামে লিখেছেন – বেদনা বিধূর হৃদয়ে বলি ওগো মালিক সাঁই /বিষভরা বিশ দিয়ে বিশ্ব করলে ছাই।/কেমন বিষ দিয়ে গেলি ওরে দু’হাজার বিশ/বিষের জ্বালায় বিশ্ব কাঁদে  খুঁজে পাইনি দিশ।/প্রবাসে কাঁদছি মোরা নাই কারো হুশ /বাঁচাও মোদের ত্বরাও মালিক সামনে একুশ।
কবি বজলুর রশীদ চৌধূরী একজন গ্রামীণ কবি, মাটির কবি, দেশের কবি। তাই তাঁর কবিতায় বারবার উঠে এসেছে গ্রাম, গ্রামের মানুষ, দেশ, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু, একুশ, জেনারেল ওসমানী, জন্মভূমি জগন্নাথপুরের প্রকৃতি। তিনি লিখেছেন শতবর্ষে জাতির পিতা, জামাইকাটা হাওর, আমার সিলেট, আমার গ্রাম, এসো আমার গাঁয়, শ্যামল বাংলা, ষড়ঋতু, বাংলার বারোমাস, রক্তঝড়া একুশ, রক্তভরা স্বাধীনতা, স্বাধীনতার কথা সোনার দেশ প্রভৃতি সব কবিতা। তিনি তার গ্রামে পল্লীকবি জসিমউদদীনের মত নিমন্ত্রণ করে ‘এসো আমার গাঁয়’ শিরোনামে লিখেছেন – আমায় যদি পড়ে মনে যেয়ো শ্যামল গাঁয় /যেথায় আমার ছোট্ট কুঠির বনের ছায়/শোনো বনের সরু পথ গেছে আমার গাঁ/শিশির পরা ঘাসের পাতা ধুয়ে দিবে পা /পথের ধারে গাছগাছালি মাঠে গরু চরে/রাখালীয়া বাঁশির সুর মনকে উদাস করে /ক্লান্ত যদি লাগে ভাই বস গাছের ছায়/চিকন চিকন কচি পাতা বাতাস দিবে গায় /সবুজ ঘেরা মাঠের পরে কত কিষাণ যায় /সাঁঝের বেলা লাঙ্গল কাধে চলে আপন গাঁয়।
মানুষ মাত্রই মরণশীল। কবি বজলুর রশীদ চৌধূরী এইকথা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন। তাঁর মর্মে মর্মে তাই তাঁর স্রষ্টা, ধর্ম, সম্প্রীতি নাড়া দেয় সবসময়। তিনি তাই লিখেছেন ধর্ম,মাহে রমজান, মহাসৃষ্টি, আজান, মসজিদ ইত্যাদি কবিতা। তিনি প্রতিনিয়ত তাঁর কর্মফলের জন্য স্রষ্টার কাছে নিজেকে জবাবদিহিমূলক সমর্পণ করেন, যা একজন স্বার্থক কবির বেলাই সম্ভব। তাই তো তিনি মাফ চাই মাওলা কবিতা শিরোনামে লিখেছেন – আকুল সুরে ডাকি মোরা ওগো মালিক সাঁই/পাপের ভরা জীবন মোদের তোমার দয়া চাই।/তোমার হুকুম নাহি মেনে পাপে আছি লিপ্ত /তবু তোমার দয়ায় ভাসি হওনি কভু ক্ষিপ্ত।/তওবা করে বলছি মোরা মালিক সাঁই /এইযাত্রা রক্ষা করো দাও গো মোদের ঠাই। /পাপের পথে যাবো নাকো ফেলবো নাকো পাও /তোমার বান্দা কাঁদছে দেখো নয়ন মেলে চাও/যত জ্ঞান যত বিজ্ঞান সবই আজি অসার/তুমি মালিক তুমি খালিক তুমি কর দিদার।
কবি বজলুর রশীদ চৌধূরী হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষে লিখেছেন – একুশ অমর বিজয় অমর, অমর স্বাধীনতা /শহীদ অমর গাজী অমর জাতির পিতা/কথা অমর ভাষণ অমর, অমর সাত-ই মার্চ /যে ভাষণে বন্ধ হয় পাক সেনাদের শ্বাস।/চলন অমর বলন অমর, অমর তাহার দেহ/জন্ম অমর কর্ম অমর, অমর টুঙ্গির হেগ /জেল অমর জুলুম অমর, অমর কারাবাস। /চির অমর হয়ে আছে পিন্ডি ফাঁসির ফাঁস। /দেশ অমর জাতি অমর, অমর ইতিহাস /  গরিব-দুঃখী লয়ে যিনি করলেন বসবাস।
কিভাবে শুরু করবো! কোন বিশেষণ নামের সাথে জুড়ে দিলে যথার্থ হবে খুঁজে পাওয়া কঠিন। এতো লম্বা  তার ক্যারিয়ার এতো জনপ্রিয় একজন কবি, যার লেখা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ হয় তিনি আর কেউ নয়,তিনি আমার প্রিয় শ্রদ্ধেয়  কবি বজলুর রশীদ চৌধূরী।
১৯৫৯ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবকিছু এখনো ভালোভাবে গুছিয়ে উঠা হয়নি। মাত্র তিন বছর আগে বৃটিশরা বাংলা ছেড়ে গিয়েছে। ভাষা আর অধিকার নিয়ে দেশে তখন আন্দোলন কেবল দানা বাঁধছে। এমনি এক সময়ে ৩ আগস্ট সানাওর আলী চৌধূরী ও সামছুন নেছা চৌধূরীর ঘর আলোকিত করে জন্ম নিলো এক শিশু। তার নাম বজলুর রশীদ চৌধূরী। হ্যাঁ, তিনিই কবি বজলুর রশীদ চৌধূরী। তাঁর পিতা ছিলেন শিক্ষক। পিতামহ আজহার আলী ছিলেন ফার্সি ভাষায় পন্ডিত, তিনি ভারতের শিলং কলেজে শিক্ষকতা করতেন। গ্রামের প্রকৃতি, পারিবারিক ঐতিহ্য আর কিছুদিন পরই ভাষা আন্দোলন ও সমসাময়িক পরিবেশ মিলিয়ে নাড়া দিতে থাকে। সময় যায়, গাছের পাতা শুকায় আবার সতেজ হয়। একসময় বজলুর রশীদ চৌধূরী হয়ে উঠেন কবি বজলুর রশীদ চৌধূরী। কবি ভালোবাসেন মানুষ, প্রকৃতি ও প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ। কবি বজলুর রশীদ চৌধূরী প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন গ্রামের পাঠশালায়। এরপর তিনি সিলেট এতিম স্কুলে ৭ম শ্রেণী পর্যন্ত এবং পরে নবগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। পরবর্তীতে তিনি মীরপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৬৮ মাধ্যমিক পাশ করেন। তিনি ১৯৭৪ সালে সিলট ঐতিহ্যবাহী এম.সি কলেজ থেকে বাংলায় বিএ (সম্মান) ডিগ্রি অর্জন করেন। কর্মজীবনে তিনি ব্যাংকে চাকরি সহ বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষকতা করেন। ২০০৩ সালে তিনি সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান এবং স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে এখন মিশিগান অঙ্গরাজ্যে বসবাস করছেন। কবির সব-কটি কবিতা আমার ভীষণ প্রিয়। ফেইসবুকে প্রায়ই লক্ষ্য করে দেখি  পাঠবৃন্দ  কবির  কবিতার খুব প্রশংসা করছেন। আমি কবির সুস্বাস্থ্য ও শতায়ু কামনা করছি।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০  

All Rights Reserved ©2024