শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

মিশিগানের একাল সেকাল

বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত দেশ যুক্তরাষ্ট্র।এখানে এলেই কোটিপতি হওয়া যাবে—এমন স্বপ্ন নিয়ে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে মানুষজন শিক্ষা বা কাজের সন্ধানে ছুটে আসে এই দেশে। কিন্তু স্বপ্ন আর বাস্তবতা সব সময়ই আলাদা হয়। দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানো মানুষগুলোও সেটা খুব দ্রুতই বুঝতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্রে যেসব বাংলাদেশি কাজের জন্য আসে, তাদের বেশির ভাগেরই গন্তব্য হয় নিউইয়র্কে। কিন্তু এই শহরটার জীবনযাত্রার খরচ এতই বেশি যে, স্বল্প আয়ের মানুষজন তো বটেই, এমনকি মধ্যম আয়ের লোকজনও সেখানে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে হিমশিম খান। এ জন্যই বাংলাদেশি প্রবাসীদের অনেকেই নিউইয়র্ক ছাড়তে শুরু করেন। কেউ কেউ চলে আসেন মিশিগান অঙ্গরাজ্যে, ল্যান্সিং যার রাজধানী।যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা সীমান্তে অবস্থিত মিশিগান নামের অঙ্গরাজ্যটি। ছবির মতো সাজানো-গোছানো তেমন একটা ছিল না। এই রাজ্যে বাঙালিদের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। হিন্দিতে একটা প্রচলিত কথা আছে—হাম জাঁহা যাতে হ্যায়, উসি জাগা কো আপনা মুলক বানা লেতে হ্যায় (আমরা যে জায়গাতেই যাই, সেই জায়গাটাকেই নিজেদের দেশ বানিয়ে ফেলি)। ভারতীয়রা এটা বলতেই পারে, কারণ ভারত হলো বিশাল এক দেশ। বিশ্বের নানা প্রান্তে অজস্র ভারতীয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। আমাদের জনসংখ্যা অনেক বেশি হলেও, দেশটা ছোট। বাইরের কোনো দেশে গিয়ে রাজত্ব করার মতো অবস্থা প্রবাসী বাংলাদেশিদের নেই।তবে শুনে অবাক হবেন, মিশিগান বর্তমানে এমন এক রাজ্যে পরিণত হয়েছে, যেখানে বাঙালিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। এখানে প্রবাসী বাংলাদেশিরাই নিয়ন্ত্রণ করছেন ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে প্রায় সবকিছু। বর্তমানে মিশিগানে বসবাস করছে প্রায় ৭০ হাজার বাংলাদেশি। এ রাজ্যের ডেট্রয়েট ও হ্যামট্র্যামেকে সবচেয়ে বাংলাদেশি বাস করে। এ যেন মিশিগানের বুকে ছোট্ট এক টুকরো বাংলাদেশ। শুনেছি এক সময় নাকি ডেট্রয়েটকে বলা হতো যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী। তখন ডেট্রয়েট ছিল খুব জমজমাট। কারণ, ডেট্রয়েটভিত্তিক মোটরগাড়ি নির্মাণ শিল্প যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ছিল অন্যতম। ২০০১ সালে আমি বাংলাদেশ থেকে সরাসরি চলে আসি ডেট্রয়েট শহরে। তখন ডেট্রয়েট শহরটা ছিল সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য। চোর, ডাকাত, ড্রাগ ডিলার থেকে শুরু করে খুনি—সব ধরনের অপরাধীই প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াত এই শহরে। শহরের বাসিন্দা ছিল খুবই কম। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই দোকানপাট বন্ধ করে সবাই ঘরে ঢুকে যেত—এমনই ছিল অবস্থা। শহরের অধিবাসীদের অনেকেই চলে গিয়েছিলেন শহর ছেড়ে। তাদের বাড়িঘরগুলো পড়ে ছিল পরিত্যক্ত অবস্থায়। ধীরে ধীরে নিউইয়র্ক ও অন্যান্য শহর থেকে প্রবাসী বাংলাদেশিরা আসতে শুরু করে এই শহরে। এখানে জমির দাম ছিল কম। বাড়ি পাওয়া যেত নিউইয়র্কের তুলনায় প্রায় জলের দরে। নিউইয়র্কে একটা ফ্ল্যাটের কয়েক মাসের ভাড়া দিয়ে এখানে আস্ত একটা বাড়ি কিনে ফেলা যেত। জীবনযাত্রার খরচও ছিল যুক্তরাষ্ট্রের অন্য অনেক শহরের তুলনায় অনেক সস্তা।বাংলাদেশিদের হাত ধরেই ডেট্রয়েট শহরটা আমূল বদলে গেছে। এই শহর এখন কোলাহলে পরিপূর্ণ। রাস্তায় গাড়ি আর মানুষের ভিড়, মসজিদের সামনে মুসল্লিদের আনাগোনা, বেশির ভাগ দোকান আর খাবারের রেস্তোরাঁর মালিক বাংলাদেশিরা। এই বাংলাদেশি প্রবাসীরাই শহরটাকে বদলে দিয়েছেন; বসবাসের উপযোগী করে তুলেছেন। বিশাল যুক্তরাষ্ট্রের বুকে ছোট এক টুকরো বাংলাদেশ হয়ে আবারও জ্বলজ্বল করছে ডেট্রয়েট নামের এই শহর!মিশিগান অঙ্গরাজ্যের প্রধান শহর ডেট্রয়েটের পাশের হ্যামট্র্যামেক শহরে বাংলাদেশি অভিবাসীদের বসবাস হলেও এ শহরে বাংলাদেশিদের মতো পোল্যান্ড ও ইয়েমেনের অভিবাসীদের সংখ্যাও অনেক।

বাংলাদেশের সঙ্গে দূরত্ব ও পরিবেশের বিস্তর ফারাক থাকলেও হ্যামট্র্যামেক শহরে তা বুঝে ওঠা কঠিন। শহরের একটি রাস্তার নামকরণ করা হয়েছে ‘বাংলাদেশ অ্যাভিনিউ’ নামে। এ ছাড়া শহরটি এখন ‘বাংলা টাউন’ নামে পরিচিত। এমনকি এ শহরের নির্বাচনের ব্যালট পেপারও ছাপা হয় বাংলায়। ডেট্রয়েট-হামট্রামেক শহরের সীমানায় ৩১০৫ কার্পেন্টার অ্যাভিনিউয়ে অবস্থিত ব্রিজ একাডেমি মাধ্যমিক স্কুলের বিশাল দেয়ালে বাংলাদেশের ঐতিহ্য, জাতীয় প্রতীক এবং ভাষা আন্দোলন নিয়ে রয়েছে একটি ম্যুরাল। পুরো দেয়াল জুড়ে যেনো ফুটে উঠেছে লাল সবুজের বাংলাদেশ।চা বাগান থেকে শুরু করে এক বাংলাদেশি আমেরিকান নারী, জাতীয় পতাকা, শহীদ মিনার, রয়েল বেঙ্গল টাইগার,মাতৃভাষা বাংলার জন্য আত্মত্যাগের ইতিহাস ধারণ করতে আঁকা হয়েছে ‘অ’ ‘আ’ ‘ক’ ‘খ’ বর্ণমালা তাছাড়া রয়েছে আমাদের জাতীয় ফুল শাপলা।

মিশিগানে বসবাস করে প্রায় ৭০ হাজার বাংলাদেশি। নিউইয়র্কের পর এটিই দ্বিতীয় বাংলাদেশিবহুল অঙ্গরাজ্য। তবে তারপরও এই বাংলাদেশিদের পাসপোর্ট, ভিসাসহ বিভিন্ন কাজের জন্য নিউইয়র্ক অফিস অথবা ডিসিতে যেতে হয় অথবা ই-মেইলের মাধ্যমে সেবা নিতে হয়। এত ঝামেলা পোহাতে হয়। সেসব ঝামেলা এড়াতে মিশিগানের বাংলাদেশিরা মিশিগানে স্থায়ী কনস্যুলেট অফিস চালুর দাবি জানিয়ে আসছে অনেক দিন ধরে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ দাবিকে গ্রাহ্য করে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এখানে বাংলাদেশিরা যারা বসবাস করেন, তাঁদের প্রতি বছর ভ্রাম্যমাণ কনস্যুলেট সার্ভিস সেবা দিতে ওয়াশিংটন ডিসি অথবা নিউইয়র্কের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে কর্মকর্তারা আসেন। কিন্তু এটা সাময়িক সেবা। ডিজিটাল বাংলাদেশ যখন বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, যখন প্রতি বছর নানা উপলক্ষ খুঁজে বিদেশিদের পাঠানো টাকা বা রেমিট্যান্সের জন্য আনন্দ প্রকাশ করা হয়, তখন একটা কনস্যুলেট অফিস স্থাপনের যৌক্তিক দাবি পূরণে কেন এত যুগ অপেক্ষা করতে হবে? বাংলাদেশে একের পর এক সরকার এসেছে, কিন্তু মিশিগানপ্রবাসী বাংলাদেশিদের এই দাবির প্রতি নির্লিপ্ততায় কোনো বদল হয়নি। এই অচলায়তন ভাঙা দরকার।এক সময় মিশিগান অঙ্গরাজ্যে ইরাক, ইয়েমেন ও পোল্যান্ডের মানুষ সংখ্যায় বেশি ছিল। তবে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশি কমিউনিটি এখানে খুব শক্তিশালী হয়েছে। এখানে এখন বাঙালিদের নিজেদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। অনেক বাংলাদেশিরই একাধিক বাড়ি আছে এখানে। বাংলাদেশি ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য আছে বাঙালি স্কুলও। ধর্মীয় শিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মন্দির-মসজিদ; রয়েছে মাদ্রাসাও। এখানকার বাঙালিরাই প্রতিষ্ঠা করেছে এসব প্রার্থণালয় ও ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আছে ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারও। ২০০৪ সালে মিশিগানের হ্যামট্র্যামেক শহরে সর্বপ্রথম লাউডস্পিকারে আজান শোনা গেছে। এখানে ধর্ম, জাত কিংবা বংশ নিয়ে দ্বন্দ্ব নেই। সবার একটাই পরিচয়—আমরা সবাই ‘বাঙালি’। এই শহরটা আবার হিজাবের শহর নামেও পরিচিত। এখানকার মুসলিম নারীদের প্রায় সবাই বাইরে বের হওয়ার সময় হিজাব পরে বের হন বলেই এই নাম।বাংলাদেশি প্রবাসীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অপরাধপ্রবণ এই অঙ্গরাজ্যের অপরাধমূলক কার্যক্রমও কমে এসেছে। যেসব অপরাধী একসময় এখানে দাপিয়ে বেড়াত, তাদের অনেকেই অন্যত্র চলে গেছে। বাংলাদেশিদের আবাসস্থল হিসেবে এই অঙ্গরাজ্য এখন বাংলাদেশিদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। রিয়েল এস্টেট প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশ কয়েকটিরই নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশিদের হাতে হওয়ায় সহজ কিস্তিতেও বাড়ি কেনার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। সঙ্গে রয়েছে একেবারে চেনা আবহে পরিবার নিয়ে বাস করার সুবিধা। অনেকেই এখন দেশ ছাড়ার সময়ই ঠিক করছেন, তারা মিশিগানে স্থায়ী হবেন। ভবিষ্যতে নিশ্চিতভাবে মিশিগানের সীমানার ভেতরে বাংলাদেশের সবুজ আরও গাঢ় হবে; উজ্জ্বল হবে তার লাল টুকটুকে আভা।

শেয়ার করুনঃ

সর্বশেষ

বিজ্ঞাপন

আর্কাইভ

শনি রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০  

All Rights Reserved ©2024