লেখকঃ পত্রলেখা ঘোষ
বিমলবাবুর খুব বিদেশ যাওয়ার শখ। এতদিন প্রাইভেট অফিসে চাকরি করতেন,তেমন বড় ছুটি পেতেন না বলে অবসর গ্রহণের পরই ঠিক করলেন আমেরিকায় তাঁর ভাইয়ের কাছে ঘুরতে যাবেন। এতকাল ভাই ও তার পরিবার অনেকবার যেতে বলেছেন, এবার সুযোগ পেয়েই পাড়ি দিলেন ক্যালিফর্নিয়ায়।
এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশনের কাজকর্ম সেরে বের হতে হতে রাত হয়ে গেল,তারপর ভাই তাঁকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে গেলেন। ভাই ও তাঁর পরিবার তাঁকে আমেরিকার নানা দর্শনীয় জিনিস দেখাবেন, স্থির হলো। কিন্তু বিমলবাবু আবার বাইরে ঘুরতে এসে একটু ও সময় নষ্ট করতে চান না, যখনই সুযোগ পান তখনই ট্যুরিস্ট ম্যাপ, কিছু টাকা আর মোবাইলটি নিয়ে বেড়িয়ে পরেন চারদিক দেখতে, স্থানীয় লোকজন কি করে, কি খায় -তা জানতে তিনি খুব উৎসুক। বলা হয়েছে কোনো বিপদে পড়লেই যেন ভাইয়ের মোবাইলে ফোন করেন।
বিমলবাবু শুনেছেন আমেরিকায় তো প্রচুর ভারতীয় থাকেন, কই পথেঘাটে তেমন ভারতীয় দেখছেন না তো! বিদেশে গেলে দেশের প্রতি টান শতগুণ বেড়ে যায়, তাই প্রবাসী ভারতীয়দের দেখার জন্য তিনি উদগ্রীব।
দিনকয়েক হলো মর্নিং ওয়াকের সাথে সাথেই শহরটি চেনার চেষ্টা ভালোই চলছে। একদিন একটু বেলার দিকে তিনি পথে হাঁটছেন, এমন সময় একজন টি-শার্ট, প্যান্ট পরিহিত বছর বাইশের একটা মেয়ে তাঁকে ইংরাজীতে জিজ্ঞাসা করলো, আঙ্কেল বলতে পারেন ভিক্টোরিয়া মার্কেট কোথায়? উনি ভালো করে ট্যুরিস্ট ম্যাপে ভিক্টোরিয়া মার্কেট দেখে বললেন আমি তো এখানেই যাবো, আমার সাথে যেতে পারেন। মেয়েটি জানালো সে মার্কেটে যাবে না, মার্কেটের পাশের রাস্তা দিয়ে তার বন্ধুর বাড়িতে যাবে।
দুজনেই পথ চলতে লাগলেন, মেয়েটি সুশ্রী, স্মার্ট, কথাবার্তায় কোনো জড়তা নেই, ইংরেজিতে কথা বলছে। হঠাৎ মেয়েটি তাঁকে বললো, আঙ্কেল আপনি কি ইন্ডিয়ান, এখানে বেড়াতে এসেছেন? বিমল বাবু বললেন হ্যাঁ কলকাতার লোক, আপনি? সে ও উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো, আরে আমি ও তো ভারতীয়, দিল্লীর মেয়ে। আমার মা বাঙ্গালী, বর্ধমানে মামার বাড়ি, আপনি বাংলায় কথা বলুন, আমি ভালোই বাংলা বুঝি। আপনার কথাবার্তা আর চালচলন দেখে মনে হলো আপনি ইন্ডিয়ান।
ব্যাস দুজনের কথাবার্তা জমে উঠলো।মেয়েটি বাংলা, ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলা শুরু করলো আর বিমল বাবু বাংলায়।তারপর মেয়েটি বিমল বাবুকে দেশের নানা কথা জিজ্ঞাসা করলো, দেশী ভাষা শুনে খুব ভালো লাগছে এবং দেশকে ভীষণ মিস করে, দেশে তার পরিবার আছে তাও জানালো।
পথে চলতে চলতে হঠাৎ বিমলবাবু বললেন আচ্ছা বাবা মাকে ছেড়ে এতদূরে থাকো, তোমার ভয় করে না? সে অবাক হয়ে বললো ভয় কিসের? অফিস থেকে ঠিক করে দিয়েছে আমরা পাঁচজন ভারতীয় একসাথে থাকি, সবাই সবায়ের বন্ধু হয়ে গেছি-সবাই সবাইকে দেখি। আজকাল পৃথিবীটা খুব ছোট হয়ে গেছে আঙ্কেল, রোজ ভারতে বাড়িতে ও নানা বন্ধুদের ফোন করি, দিনরাত সবাই মেসেজ পাঠায়, ভিডিও কলে সকলকে দেখি, কোনো অসুবিধা হলে বাড়ির লোক টাকা পাঠায়, কি সমস্যা! ছুটি পেলেই আমি ভারতে আসি, মা বাবা ভাই আমার কাছে এলে তো মেসে থাকা যায় না-তখন হোটেলে ওদের সাথে থাকি এইভাবেই চলে। আবার কোম্পানীর ভারতে শাখা সংগঠন আছে, তাদের দিল্লী ও ব্যাঙ্গালোর শাখায় আমাদের পাঠায়,অতএব ভাবনা কিসের!
বিমল বাবু মনে মনে ভাবলেন ভারতীয় মেয়েরাও আজকাল কত স্মার্ট হয়ে গেছে। বিমল বাবু জিজ্ঞাসা করলেন তুমি কি সারাজীবন এদেশেই থাকবে স্থির করেছো? মেয়েটি বললো আমি এদেশে রোজগার করতে এসেছি, এই টাকা থেকেই ধীরে ধীরে দেশে একটা পারিবারিক ব্যবসা করবো। তারপর রোজগার করা হয়ে গেলে দেশে ফিরে আসবো, ভারত ই আমার দেশ। তারপর মেয়েটি তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে নিজ গন্তব্যস্থলে চলে গেল।
আস্তে আস্তে সে বিমল বাবুর দৃষ্টির অগোচরে চলে গেল। তাঁর মনে হলো একখন্ড ভারতবর্ষ কখন যেন বড় কাছাকাছি এসে পড়েছিল, আবার নিজের খেয়ালেই অনেক দূরে সরে গিয়ে হারিয়ে গেল।