অপরাধের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন শেখ হাসিনা

জুলাই-আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের সময় ব্যাপক হত্যাকা-সহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বিচারকাজ শুরু হয়েছে। গতকাল রবিবার বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে গঠিত তিন বিচারকের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ রাষ্ট্রপক্ষ ও প্রসিকিউশনের সূচনা বক্তব্যের পর সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। ট্রাইব্যুনালের বিচারিক প্যানেলের অন্য দুই সদস্য বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং বিচারপতি মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। সূচনা বক্তব্যের পর সাক্ষ্য দেন গণআন্দোলনের সময় গুলিতে মুখাবয়ব মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া খোকন চন্দ্র বর্মন। তিনি জুলাই-আগস্টে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার প্রথম সাক্ষী। নিরাপত্তাজনিত কারণে খোকনের বিস্তারিত পরিচয় প্রকাশ করেনি প্রসিকিউশন।

তার সাক্ষ্যের পর তাকে জেরা করেন পলাতক শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে শুনানিকারী রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমীর হোসেন। প্রথমদিনের শুনানি নিয়ে আজ সোমবার পরবর্তী শুনানি ও জেরার দিন ধার্য করে ট্রাইব্যুনাল। শেখ হাসিনাসহ অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলার অন্য আসামি পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনকে গতকাল কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় হাজির করা হয়। পুলিশের সাবেক এই শীর্ষ কর্মকর্তা এই মামলার রাজসাক্ষী (অ্যাপ্রোভার)।

শুনানিকালে সাক্ষী খোকন আন্দোলনে অংশগ্রহণের বিষয়টি আদালতে তুলে ধরেন। ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ী এলাকায় তিনি কীভাবে গুলিবিদ্ধ হন এবং তার মুখমন্ডল বিকৃত হয়ে যায়, তাও আদালতে উল্লেখ করেন তিনি। ওইদিন যাত্রাবাড়ী এলাকায় পুলিশ কীভাবে ব্যাপক হত্যাকান্ড ঘটায়, সাক্ষ্যে তাও উল্লেখ করেন তিনি। গুলির আঘাতে খোকনের মুখমন্ডলের সম্মুখভাগের বড় অংশ হাড়সহ নষ্ট হয়ে যায়। তার ঠোঁট, মাড়ি, নাক, তালু এগুলোর কোনো অস্তিত্ব এখন নেই। খোকনের মুখাবয়ব স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল হওয়ায় সরকারিভাবে দেশের বাইরে যোগাযোগ করা হয়। রাশিয়ার মস্কোর ইউনিভার্সিটি ক্লিনিক অব লোমোনোসোভ হাসপাতাল খোকনের মুখ পুনর্গঠনের চিকিৎসায় সম্মত হয়। গত ২১ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ায় পাঠানো হলে প্রথম পর্বের চিকিৎসা নিয়ে গত ৭ মে খোকন দেশে ফেরেন। সাক্ষ্য দেওয়ার সময় খোকন নিজের ক্ষতিগ্রস্ত মুখমন্ডল দেখিয়ে শেখ হাসিনার বিচারের আরজি জানান।

গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন। গণআন্দোলন দমাতে এক হাজারের বেশি মানুষ হত্যা ও ২০ হাজারের বেশি মানুষকে গুলি ও নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গণঅভ্যুত্থানে হত্যাকা- ও নির্যাতনের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরুর উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন শাখা ও তদন্ত সংস্থা পুনর্গঠন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রথম কোনো মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হলো।

শেখ হাসিনা মিথ্যাবাদী স্বৈরাচার : অ্যাটর্নি জেনারেল

গতকাল বেলা ১১টার কিছু পর বিচারকাজ শুরু হয়। সে সময় আদালতের অনুমতি নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষে সূচনা বক্তব্য শুরু করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জমান। তিনি বলেন, আজকে (গতকাল) একটি ঐতিহাসিক শুভক্ষণে দাঁড়িয়ে কথা বলার সুযোগ পেয়েছি। সে সময় তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্বৈরাচারের উত্থান, তাদের পতন ও পরিণতির বেশ কিছু উদাহরণ তুলে ধরেন। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে গুম, খুন, দুর্নীতি ও লুটপাটের রাজনীতি করেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক স্বৈরাচার পালিয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনার মতো কোনো স্বৈরাচারের জন্ম হয়নি। তিনি (শেখ হাসিনা) পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মিথ্যাবাদী স্বৈরাচার।’ অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘মৃত্যুদন্ড নিয়ে অনেক কথা ওঠে। কিন্তু আমাদের সামনে যে ইতিহাস, তা নির্মম হত্যাকান্ডের ইতিহাস। জুলাই বিপ্লবের দাবি ছিল মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করা। কিন্তু সে দাবি আদায় করতে গিয়ে ৩০ হাজার মানুষ পঙ্গুত্ববরণ করেছে। প্রায় দুই হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে স্বৈরাচার ও তার সহযোগীদের সর্বোচ্চ শাস্তি আমরা চাই। আমরা আশা করছি, মামলার উপাদান ও সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। আগামীর বাংলাদেশ বসবাসের উপযোগী হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘কারও প্রতি আমাদের ব্যক্তিগত কোনো ক্ষোভ নেই। তিনি (শেখ হাসিনা) এখন আপনাদের (আদালত) সামনে একজন অপরাধী। আমরা সেই অপরাধীর বিচার চাইতে এসেছি। আমরা ন্যায়বিচার চাইতে এসেছি। ব্যক্তি নয়, অপরাধই মুখ্য। ব্যক্তি যেই হোক, অপরাধ করলে তার বিচার করার জন্য আমরা সংকল্পবদ্ধ।’

সূচনা বক্তব্যে যা বললেন চিফ প্রসিকিউটর

সূচনা বক্তব্যে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আজ (গতকাল) এই আদালত বসেছে সবচেয়ে ভয়াবহ অপরাধের বিচার করতে। কোনো ব্যক্তি যত উঁচু পদেই আসীন হোন কিংবা তার ছায়া যত দীর্ঘই হোক না কেন, তিনি আইনের ঊর্ধ্বে নন। আমরা এই ট্রাইব্যুনালের কাছে নিবেদন করছি, যেন দোষীদের সঠিক জবাবদিহি নিশ্চিত করা হয়। বিচারব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করা হয় এবং বিশ্বকে এই বার্তা দেওয়া হয় যে, অপরাধী যত বড়ই হোক, তার জন্য বিন্দুমাত্র ছাড় থাকবে না।’ তিনি বলেন, ‘এই ট্রাইব্যুনালে দুই আসামির (শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল) অনুপস্থিতিতে বিচার কোনোভাবেই অপরাধীর জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য বাধা হতে পারে না এবং হবে না। দুজন আসামি আদালতের ক্ষমতার কাছে আত্মসমর্পণ না করে বারবার অনুপস্থিত আছেন। স্পষ্টভাবে বলা প্রয়োজন, আসামির ইচ্ছাকৃত পলায়ন কিংবা কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয়তা এই ট্রাইব্যুনালের সত্য অনুসন্ধান এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিতের গুরুদায়িত্বকে বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না।’

চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘একনায়কতান্ত্রিক শাসক হিসেবে তিনি (শেখ হাসিনা) এককভাবে সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতেন। তার অধীনস্থ কর্মকর্তারা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে তার নির্দেশ বাস্তবায়নে সর্বদা আগ্রহী ছিলেন। জুলাই আন্দোলনের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনার ক্ষমতা ধরে রাখা। তিনি (শেখ হাসিনা) ছিলেন এসব অপরাধের কেন্দ্রবিন্দু বা নিউক্লিয়াস। অন্য আসামিরা তার অধীনে থেকে বুঝতেন যে শেখ হাসিনার ক্ষমতায় থাকার ওপরই তাদের নিরাপত্তা ও পুরস্কার নির্ভর করছে।’ তিনি বলেন, ‘এই মামলার মূল প্রতিপাদ্য আইনের শাসনের সেই মূলনীতি, যে কারও পদমর্যাদা বা আগের অবস্থান যাই হোক না কেন, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন।’

গত ১০ জুলাই প্রসিকিউশনের দাখিল করা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচ অভিযোগে ৮১ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দেবেন। গণআন্দোলন দমনে হত্যার উসকানি, প্ররোচনা, নির্দেশ প্রদান, রংপুরে আবু সাঈদ হত্যা, রাজধানীর চানখাঁরপুলে ছয়জনকে হত্যা, সাভারের আশুলিয়ায় ছয়জনকে গুলি করে হত্যার পর লাশ পুড়িয়ে ফেলার ঘটনায় ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপন্সিবিলিটি’র অভিযোগ আনা হয়েছে আসামিদের বিরুদ্ধে।

১২ মে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। এরপর ১ জুন তিন আসামির বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের দাখিল করা অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল। ওইদিন শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করে ১৩টি ভলিউমে সাড়ে ৮ হাজার পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হয়।

হাজার হাজার মানুষকে মারার জন্য শেখ হাসিনা দায়ী : সাক্ষী খোকন

জবানবন্দিতে সাক্ষী খোকন বর্মন (২৩) বলেন, হাজার হাজার মানুষকে মারার জন্য শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, পুলিশের সাবেক আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ও সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান দায়ী। তিনি বলেন, আমি তাদের বিচার চাই। বিচার হলে শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে। তিনি বলেন, গত বছর ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ১৮ ও ১৯ জুলাই নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় তিনি আন্দোলনে যোগ দেন। ৫ আগস্ট রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় পুলিশ আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে। এ সময় আন্দোলনকারী একজনের মাথায় গুলি লেগে বের হয়ে হয়ে অন্যজন আহত হন। যাত্রাবাড়ীতে আন্দোলনের একপর্যায়ে আওয়ামী লীগের পতনের খবর পান। এ সময় যাত্রাবাড়ী থানার সামনে দাঁড়িয়ে আন্দোলনকারীরা সেøাগান দিতে থাকে। কিছুক্ষণ পর পুলিশ বের হয়ে পাখির মতো গুলি করতে থাকে। তখন যে  যেভাবে পারে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, তিনিসহ কয়েকজন ফ্লাইওভারের নিচে পিলারের পেছনে লুকিয়ে থাকেন। সে সময় পুলিশ টার্গেট করে গুলি করে। গুলি তার চোখ, নাক ও মুখে লাগে।  মুখমন্ডল বিকৃত হয়ে যায়। তিনি হাত নেড়ে সাহায্য চাইলে কয়েকজন সহযোদ্ধা প্রথমে তাকে মুগদা হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে তাকে ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়।

Tag :
জনপ্রিয়

অপরাধের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন শেখ হাসিনা

আপডেট ০৮:৫৭:২২ পূর্বাহ্ণ, সোমবার, ৪ আগস্ট ২০২৫

জুলাই-আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের সময় ব্যাপক হত্যাকা-সহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বিচারকাজ শুরু হয়েছে। গতকাল রবিবার বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে গঠিত তিন বিচারকের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ রাষ্ট্রপক্ষ ও প্রসিকিউশনের সূচনা বক্তব্যের পর সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। ট্রাইব্যুনালের বিচারিক প্যানেলের অন্য দুই সদস্য বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং বিচারপতি মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। সূচনা বক্তব্যের পর সাক্ষ্য দেন গণআন্দোলনের সময় গুলিতে মুখাবয়ব মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া খোকন চন্দ্র বর্মন। তিনি জুলাই-আগস্টে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার প্রথম সাক্ষী। নিরাপত্তাজনিত কারণে খোকনের বিস্তারিত পরিচয় প্রকাশ করেনি প্রসিকিউশন।

তার সাক্ষ্যের পর তাকে জেরা করেন পলাতক শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে শুনানিকারী রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমীর হোসেন। প্রথমদিনের শুনানি নিয়ে আজ সোমবার পরবর্তী শুনানি ও জেরার দিন ধার্য করে ট্রাইব্যুনাল। শেখ হাসিনাসহ অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলার অন্য আসামি পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনকে গতকাল কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় হাজির করা হয়। পুলিশের সাবেক এই শীর্ষ কর্মকর্তা এই মামলার রাজসাক্ষী (অ্যাপ্রোভার)।

শুনানিকালে সাক্ষী খোকন আন্দোলনে অংশগ্রহণের বিষয়টি আদালতে তুলে ধরেন। ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ী এলাকায় তিনি কীভাবে গুলিবিদ্ধ হন এবং তার মুখমন্ডল বিকৃত হয়ে যায়, তাও আদালতে উল্লেখ করেন তিনি। ওইদিন যাত্রাবাড়ী এলাকায় পুলিশ কীভাবে ব্যাপক হত্যাকান্ড ঘটায়, সাক্ষ্যে তাও উল্লেখ করেন তিনি। গুলির আঘাতে খোকনের মুখমন্ডলের সম্মুখভাগের বড় অংশ হাড়সহ নষ্ট হয়ে যায়। তার ঠোঁট, মাড়ি, নাক, তালু এগুলোর কোনো অস্তিত্ব এখন নেই। খোকনের মুখাবয়ব স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল হওয়ায় সরকারিভাবে দেশের বাইরে যোগাযোগ করা হয়। রাশিয়ার মস্কোর ইউনিভার্সিটি ক্লিনিক অব লোমোনোসোভ হাসপাতাল খোকনের মুখ পুনর্গঠনের চিকিৎসায় সম্মত হয়। গত ২১ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ায় পাঠানো হলে প্রথম পর্বের চিকিৎসা নিয়ে গত ৭ মে খোকন দেশে ফেরেন। সাক্ষ্য দেওয়ার সময় খোকন নিজের ক্ষতিগ্রস্ত মুখমন্ডল দেখিয়ে শেখ হাসিনার বিচারের আরজি জানান।

গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন। গণআন্দোলন দমাতে এক হাজারের বেশি মানুষ হত্যা ও ২০ হাজারের বেশি মানুষকে গুলি ও নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গণঅভ্যুত্থানে হত্যাকা- ও নির্যাতনের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরুর উদ্যোগ নেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন শাখা ও তদন্ত সংস্থা পুনর্গঠন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রথম কোনো মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হলো।

শেখ হাসিনা মিথ্যাবাদী স্বৈরাচার : অ্যাটর্নি জেনারেল

গতকাল বেলা ১১টার কিছু পর বিচারকাজ শুরু হয়। সে সময় আদালতের অনুমতি নিয়ে রাষ্ট্রপক্ষে সূচনা বক্তব্য শুরু করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জমান। তিনি বলেন, আজকে (গতকাল) একটি ঐতিহাসিক শুভক্ষণে দাঁড়িয়ে কথা বলার সুযোগ পেয়েছি। সে সময় তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্বৈরাচারের উত্থান, তাদের পতন ও পরিণতির বেশ কিছু উদাহরণ তুলে ধরেন। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে গুম, খুন, দুর্নীতি ও লুটপাটের রাজনীতি করেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক স্বৈরাচার পালিয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনার মতো কোনো স্বৈরাচারের জন্ম হয়নি। তিনি (শেখ হাসিনা) পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মিথ্যাবাদী স্বৈরাচার।’ অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘মৃত্যুদন্ড নিয়ে অনেক কথা ওঠে। কিন্তু আমাদের সামনে যে ইতিহাস, তা নির্মম হত্যাকান্ডের ইতিহাস। জুলাই বিপ্লবের দাবি ছিল মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করা। কিন্তু সে দাবি আদায় করতে গিয়ে ৩০ হাজার মানুষ পঙ্গুত্ববরণ করেছে। প্রায় দুই হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে স্বৈরাচার ও তার সহযোগীদের সর্বোচ্চ শাস্তি আমরা চাই। আমরা আশা করছি, মামলার উপাদান ও সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। আগামীর বাংলাদেশ বসবাসের উপযোগী হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘কারও প্রতি আমাদের ব্যক্তিগত কোনো ক্ষোভ নেই। তিনি (শেখ হাসিনা) এখন আপনাদের (আদালত) সামনে একজন অপরাধী। আমরা সেই অপরাধীর বিচার চাইতে এসেছি। আমরা ন্যায়বিচার চাইতে এসেছি। ব্যক্তি নয়, অপরাধই মুখ্য। ব্যক্তি যেই হোক, অপরাধ করলে তার বিচার করার জন্য আমরা সংকল্পবদ্ধ।’

সূচনা বক্তব্যে যা বললেন চিফ প্রসিকিউটর

সূচনা বক্তব্যে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, ‘আজ (গতকাল) এই আদালত বসেছে সবচেয়ে ভয়াবহ অপরাধের বিচার করতে। কোনো ব্যক্তি যত উঁচু পদেই আসীন হোন কিংবা তার ছায়া যত দীর্ঘই হোক না কেন, তিনি আইনের ঊর্ধ্বে নন। আমরা এই ট্রাইব্যুনালের কাছে নিবেদন করছি, যেন দোষীদের সঠিক জবাবদিহি নিশ্চিত করা হয়। বিচারব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করা হয় এবং বিশ্বকে এই বার্তা দেওয়া হয় যে, অপরাধী যত বড়ই হোক, তার জন্য বিন্দুমাত্র ছাড় থাকবে না।’ তিনি বলেন, ‘এই ট্রাইব্যুনালে দুই আসামির (শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামাল) অনুপস্থিতিতে বিচার কোনোভাবেই অপরাধীর জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য বাধা হতে পারে না এবং হবে না। দুজন আসামি আদালতের ক্ষমতার কাছে আত্মসমর্পণ না করে বারবার অনুপস্থিত আছেন। স্পষ্টভাবে বলা প্রয়োজন, আসামির ইচ্ছাকৃত পলায়ন কিংবা কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয়তা এই ট্রাইব্যুনালের সত্য অনুসন্ধান এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিতের গুরুদায়িত্বকে বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না।’

চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ‘একনায়কতান্ত্রিক শাসক হিসেবে তিনি (শেখ হাসিনা) এককভাবে সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতেন। তার অধীনস্থ কর্মকর্তারা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে তার নির্দেশ বাস্তবায়নে সর্বদা আগ্রহী ছিলেন। জুলাই আন্দোলনের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনার ক্ষমতা ধরে রাখা। তিনি (শেখ হাসিনা) ছিলেন এসব অপরাধের কেন্দ্রবিন্দু বা নিউক্লিয়াস। অন্য আসামিরা তার অধীনে থেকে বুঝতেন যে শেখ হাসিনার ক্ষমতায় থাকার ওপরই তাদের নিরাপত্তা ও পুরস্কার নির্ভর করছে।’ তিনি বলেন, ‘এই মামলার মূল প্রতিপাদ্য আইনের শাসনের সেই মূলনীতি, যে কারও পদমর্যাদা বা আগের অবস্থান যাই হোক না কেন, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নন।’

গত ১০ জুলাই প্রসিকিউশনের দাখিল করা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচ অভিযোগে ৮১ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দেবেন। গণআন্দোলন দমনে হত্যার উসকানি, প্ররোচনা, নির্দেশ প্রদান, রংপুরে আবু সাঈদ হত্যা, রাজধানীর চানখাঁরপুলে ছয়জনকে হত্যা, সাভারের আশুলিয়ায় ছয়জনকে গুলি করে হত্যার পর লাশ পুড়িয়ে ফেলার ঘটনায় ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপন্সিবিলিটি’র অভিযোগ আনা হয়েছে আসামিদের বিরুদ্ধে।

১২ মে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। এরপর ১ জুন তিন আসামির বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের দাখিল করা অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল। ওইদিন শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করে ১৩টি ভলিউমে সাড়ে ৮ হাজার পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হয়।

হাজার হাজার মানুষকে মারার জন্য শেখ হাসিনা দায়ী : সাক্ষী খোকন

জবানবন্দিতে সাক্ষী খোকন বর্মন (২৩) বলেন, হাজার হাজার মানুষকে মারার জন্য শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, পুলিশের সাবেক আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ও সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান দায়ী। তিনি বলেন, আমি তাদের বিচার চাই। বিচার হলে শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে। তিনি বলেন, গত বছর ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ১৮ ও ১৯ জুলাই নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় তিনি আন্দোলনে যোগ দেন। ৫ আগস্ট রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় পুলিশ আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে। এ সময় আন্দোলনকারী একজনের মাথায় গুলি লেগে বের হয়ে হয়ে অন্যজন আহত হন। যাত্রাবাড়ীতে আন্দোলনের একপর্যায়ে আওয়ামী লীগের পতনের খবর পান। এ সময় যাত্রাবাড়ী থানার সামনে দাঁড়িয়ে আন্দোলনকারীরা সেøাগান দিতে থাকে। কিছুক্ষণ পর পুলিশ বের হয়ে পাখির মতো গুলি করতে থাকে। তখন যে  যেভাবে পারে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, তিনিসহ কয়েকজন ফ্লাইওভারের নিচে পিলারের পেছনে লুকিয়ে থাকেন। সে সময় পুলিশ টার্গেট করে গুলি করে। গুলি তার চোখ, নাক ও মুখে লাগে।  মুখমন্ডল বিকৃত হয়ে যায়। তিনি হাত নেড়ে সাহায্য চাইলে কয়েকজন সহযোদ্ধা প্রথমে তাকে মুগদা হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে তাকে ঢাকা মেডিকেলে পাঠানো হয়।